ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী লাল চিনি’র ই-কমার্সে ব্যাপক সম্ভাবনা

নিউজ ডেস্ক

সময় একাত্তর

প্রকাশিত : ১০:০৮ এএম, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শুক্রবার

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

‘করলে তৈরী লাল চিনির ক্ষীর, খাওয়ার জন্য পড়ে যায় ভীড়’- এমন প্রবাদের প্রচলন রয়েছে ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলায়। এই অঞ্চলে দেশ বিখ্যাত ঐতিহ্যবাহী হাতে তৈরী লাল চিনি তৈরী হয়ে থাকে।

হাতে তৈরি লাল চিনি দিয়ে বানানো পিঠা, নাড়ু, মোয়া, ক্ষীর, মিঠাই খেতে ভারি সুস্বাদু। ফুলবাড়িয়ায় এখনো নতুন জামাইকে লাল চিনির গরম ক্ষীর ও মোয়া দিয়ে আপ্যায়ন করার রেওয়াজ আছে। মুড়ি, চিড়া, আটার রুটি সঙ্গে সকালের নাস্তায়ও লাল চিনি ব্যবহার করে থাকে অনেক এলাকায়। পিঠা-পায়েস, খাজা-গজা, সেমাই-সুজি, বাতাসা, জিলাপী, খোরমা,আচার তৈরির কাজেও লাল চিনি ব্যবহার করা যায়। এছাড়া বিভিন্ন আয়ুবেদীক ঔষধ তৈরীর কাজে লাল চিনি ব্যবহার হয় বলে জানা যায়। ঘরের বৌ-ঝি রা চিনির মিঠাই কাঁচের বৈয়ামে ভরে রাখে মাসের পর মাস। সারাদিন বাড়ীর কাজ শেষে যখন তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন লাল চিনির একটুকরো মিঠাই খেয়ে ক্লান্তি দূর করে থাকে।

লালচিনির উপকারিতাঃ
লাল চিনি শুধু মজাদারই নয়, স্বাস্থ্য সম্মত। লাল চিনি মোলাসেস নামক এক প্রকার আঠাল উপাদানের জন্য চিনি লাল বা বাদামি রং ধারণ করে। এ মোলাসেস আখ থেকে চিনি উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় উপজাত হিসেবে উৎপন্ন হয়। আর এই লাল চিনির মোলাসেস অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, এতে বিদ্যমান ফলিক এসিড দেহে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে, এ চিনি দেহে রক্তকণিকা তৈরিতে সাহায্য করে, ক্ষুধামান্দ্য দূর করে, হজমে সহায়তা করে, আয়রনসমৃদ্ধ হওয়ায় প্রসব-পরবর্তী সময়ে মায়েদের জন্য উপকারী, ত্বক পরিচর্চায়ও এর ব্যবহার হয়ে থাকে।

লালচিনি উৎপাদন প্রক্রিয়াঃ
লাল চিনি তৈরির পদ্ধতি লাল চিনি এক মাত্র কাঁচামাল হলো আখ। আখের রস আগুনে জাল দিয়ে লাল চিনি তৈরি করা হয়। আমন ধান কাটার পর চাষীদের যখন তেমন কোন কাজ থাকে না তখনই তারা লাল চিনি তৈরি শুরু করে। পৌষ মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে একটানা ফাল্গুন মাস পর্যন্ত আঁখ মাড়াই ও লাল চিনি তৈরির কাজ চলে। আঁখ মাড়াইয়ের পূর্বে চাষীরা লাল চিনি তৈরীর জন্য জ্বালঘর তৈরী করে। লাল চিনি তৈরীতে প্রথমে ৩ শলা বিশিষ্ট লোহার চাপ যন্ত্রের সাহায্যে সেলু মেশিন অথবা যন্ত্রে বিদ্যুৎ চালিত মটর সংযোগ দিয়ে আবার কেউ কেউ চাপ যন্ত্রটি গরু-মহিষ দ্বারা ঘানি টেনে আঁখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে রস বের করে। জ্বালঘরে চুলায় দেয়া লোহার বড় কড়াইয়ে পরিমান মতো কাঁচা আঁেখর রস দিয়ে আধাঘন্টা পরিমান জ্বাল দিতে হয়। এক পর্যায়ে ঘন গরম সর আগুনের চুল্লী থেকে নামিয়ে পাত্রটিতে লাল চিনি তৈরীর কারিগর কাঠের তৈরী হাতল দিয়ে দ্রুত ঘর্ষন শুরু করে। আস্তে আস্তে ঠান্তা হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে ঘন জ্বাল দেয়া সর মিহি লাল দানায় রূপ নেয়। প্রতি কাঠায় ৪৫ থেকে ৫০ টিন আখের রস হয়। প্রতিটিনে ১৫ থেকে ১৬ কেজি কাঁচা রস হয়। ১টিন কাঁচা আখের রস থেকে লাল চিনি পাওয়া যায় ৪ থেকে ৫ কেজি। হাতে তৈরী এই লাল চিনি কৃষক রোদ্রে শুকিয়ে বাজারজাত করে।

সমস্যা এবং সম্ভাবনাঃ
শুধু ফুলবাড়িয়াই নয়, ত্রিশালেও কিছু কৃষকরা এখনো আখ চাষ করে এবং লাল চিনি তৈরী করে থাকে। তবে বর্তমানে সারের মূল্য বৃদ্ধি, মাড়াই সমস্যা, শ্রমিক মুজুরী বৃদ্ধি, উন্নত আখের চাড়াসহ চাষীদের প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন সু-দৃষ্টি না থাকায় আঁখ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে কৃষকরা। এই অবস্থার পরিবর্তনে অবশ্যই সরকারি বেসরকারি কৃষি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর এগিয়ে আসা উচিত এবং একটা ঐতিহ্যবাহী কৃষিপণ্যের সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগীতা করে কৃষকদের কে উৎসাহিত করা উচিত।

এছাড়াও বর্তমানে আবারও হাতে তৈরী লালচিনির ব্যবহার বাড়ছে, কারন বাড়ছে মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা। লালচিনির পুষ্টিমান এবং এর বাড়তি স্বাদের কারনেই এর চাহিদা বাড়বে বৈ কমবে না, আর একে যদি মানুষের হাতের নাগালে এনে দেয়া যায় তবে এর প্রতি মানুষের আগ্রহ আরও বাড়বে।

আর তাই আমার মতে, লাল চিনি উৎপাদনকারী কৃষকদের এবং এর সরবরাহকারীদেরকে ই-কমার্সের অন্তর্ভুক্ত করা গেলে ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ই লাভবান হবে এবং ময়মনসিংহ জেলার একটা বিখ্যাত কৃষিপণ্য কে পুরো দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেয়া যাবে। শুধু তাই নয়, দেশের বাইরেও ব্রাউন সুগার বা লালচিনির চাহিদা অনেক। সুতরাং ই-কমার্সের আওতাভুক্ত করা গেলে লাল চিনি দেশের বাইরেও সরবরাহের দ্বার উন্মোচিত হয়ে যাবে। আর এই পণ্য যেহেতু পচনশীল কোনো খাদ্যদ্রব্য নয়, তাই খাদ্যদ্রব্য সরবরাহে ই-কমার্সের যে ডেলিভারি সমস্যাগুলো হয়ে থাকে এক্ষেত্রে সেধরনের কোনো ভয় থাকছে না।

ময়মনসিংহ জেলার ঐতিহ্যবাহী পণ্যগুলোকে একে একে এভাবে ই- কমার্সের আওতায় আনতে পারলে ইনশাআল্লাহ্‌ দ্রুত বড় হবে ময়মনসিংহের দেশীয় পণ্যের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রী।