শবে কদরের ফজিলত ও আমল

নিউজ ডেস্ক

সময় একাত্তর

প্রকাশিত : ০৪:৪১ পিএম, ২০ মে ২০২০ বুধবার

শব ফারসি শব্দ, এর অর্থ রাত। আর কদর অর্থ নিবারণ করা বা মর্যাদা। পবিত্র কোরআনে রাতটিকে নাম দেয়া হয়েছে লাইলাতুল কদর। আরবি লাইলাতুন অর্থ রাত। তাহলে শবে কদর বা লাইলাতুল কদরের অর্থ দাঁড়ায় নিবারণের রাত বা মর্যাদার রাত।

এ রাতে মহান আল্লাহ সৃষ্টিকুলের আগামী এক বছরের ভাগ্যলিপি ফেরেশতাদের হাতে অর্পণ করেন, সে জন্য অথবা যেসব ব্যক্তি নিজেদের গুনাহর কারণে মূল্যহীন ছিল, তারা এ রাতের ইবাদত-বন্দেগি আর তাওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে মহান আল্লাহর দরবারে উঁচু মার্যাদার অধিকারী হন বলেই এ রাতের নামকরণ করা হয়েছে ‘শবেকদর’ বা ‘লাইলাতুল কদর’।

এ রাতের ফজিলত:

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রমজান মাস হলো সেই মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে আল-কোরআন, যা মানব জাতির জন্য হেদায়াত ও সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এবং ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী।’ (সূরা: বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫)। মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাজিল হওয়ার কারণে অন্যসব মাসের চেয়ে রমজান মাস বেশি ফজিলতময় হয়েছে। আর রমজানের রাতগুলোর মধ্যে কোরআন নাজিলের রাত লাইলাতুল কদর সবচেয়ে তাৎপর্যমণ্ডিত একটি রাত। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি একে নাজিল করেছি কদরের রাতে। তুমি কি জান কদরের রাত কি? কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। (সূরা: কদর, আয়াত: ১-৩)। এ আয়াতের ব্যাখায় মুফাসসিরকুল শিরোমণি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘এ রাতের ইবাদত অন্য হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে উত্তম’। (তানবিরুল মিকবাস মিন তাফসিরে ইবনে আব্বাস : ৬৫৪ পৃষ্ঠা)। তাবেয়ি মুজাহিদ (রা.) বলেন, এর ভাবার্থ হলো, ‘এ রাতের ইবাদত, তেলাওয়াত, কিয়াম ও অন্যান্য আমল লাইলাতুল কদর ছাড়া হাজার মাস ইবাদতের চেয়েও উত্তম।’ মুফাসসিররা এমনই ব্যাখ্যা করেছেন। আর এটিই সঠিক ব্যাখ্যা। (ইবনে কাসির : ১৮ খণ্ড, ২২৩ পৃষ্ঠা)।

সূরা কদরের শানে নুযুল সম্পর্কে ইবনে কাসির (রা.) বলেন, আলী ইবনে উরওয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বনি ইসরাইলের চারজন আবেদ সম্পর্কে বলছিলেন, তারা আশি বছর ধরে অনবরত আল্লাহর ইবাদত করছিল। এর মধ্যে মুহূর্ত সময়ের জন্যও ইবাদত থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হননি। বিখ্যাত এ চারজন আবেদ হলো আল্লাহর নবী জাকারিয়া (আ.), আইউব (আ.), হাজকিল ইবনে আ’জূজ (আ.) এবং ইউশা ইবনে নূহ (আ.)। এমনটি শুনে সাহাবিরা (রা.) রীতিমতো অবাক হলেন। এ সময় জিবরাইল (আ.) এসে বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ (সা.)! আপনার উম্মতরা এ কথা শুনে অবাক হচ্ছে? তাদের জন্য আল্লাহতায়ালা এর চেয়ে উত্তম কিছু রেখেছেন। এরপর সূরা কদর পাঠ করা হয়। (ইবনে কাসির : ১৮ খণ্ড, ২২৩ পৃষ্ঠা)।

কদরের রাতের খুঁজে:

একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) বনি ঈসরায়েলের একজন মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, তিনি এক হাজার বছর দীর্ঘ হায়াত পেয়েছিলেন। দীর্ঘ এ আয়ুষ্কাল তিনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে রত ছিলেন। একবারের জন্যও অস্ত্র সংবরণ করেননি। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ঘটনা শুনে বিস্মিত হলেন এবং আফসোস করতে লাগলেন যে, বনি ঈসরায়েল সুদীর্ঘ হায়াত পাওয়ার কারণে অনেক বেশি ইবাদত-বন্দেগি করতে পেরেছে। অনেক সওয়াব অর্জন করতে পেরেছে। আমাদেরও যদি তাদের মতো দীর্ঘ হায়াত দেয়া হতো, তাহলে আমরা তাদের মতো অনেক ইবাদত করতে পারতাম, অনেক বেশি পুণ্য লাভ করতে পারতাম। এ সময় মহান আল্লাহ সূরা কদর নাজিল করেন এবং বুঝিয়ে দেন যে, যদিও উম্মতে মোহাম্মাদিকে হায়াত কম দেয়া হয়েছে, তথাপি তাদের সওয়াব হাসিলের ও মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের এত বেশি সুযোগ দেয়া হয়েছে, যা পূর্ববর্তী কোনো উম্মতকে দেয়া হয়নি। উম্মতে মোহাম্মাদি যদি শুধু একটি রাত (লাইলাতুল কদর) ইবাদত করে, তাহলে তারা এক হাজার মাস ইবাদত করার চেয়েও বেশি সওয়াব প্রাপ্ত হবে। (তাফসিরে ইবনে কাসির)।

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,  ‘তোমরা রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো।’ (বুখারি)। তবে রমজান মাসের ২৭তম রাতটি শবেকদর হিসেবে বিশেষভাবে সমগ্র মুসলিম সমাজে উদ্যাপিত হয়। আর ব্যাপক প্রসিদ্ধ এ মতটিও হাদিস দ্বারা সমর্থিত। কদরের রাত ইবাদতের রাত। তবে নির্দিষ্ট কোনো ইবাদতের জন্য রাতটি নির্ধারিত নয়। যেকোনো ইবাদতই এ রাতে করা যেতে পারে। নফল নামাজ, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, ইস্তিগফারসহ যেকোনো ইবাদতই করা যেতে পারে। সালাতুত তাসবিহ শবেকদরের জন্য বিশেষভাবে নির্দিষ্ট না হলেও যেহেতু এ নামাজ আদায়ে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হয়, আর লাইলাতুল কদরে সারা রাতই অধিকাংশ মুসলমান জেগে থাকেন, তাই কদরের রাতে সালাতুত তাসবিহ আদায় করা যেতে পারে।

লাইলাতুল কদরের মর্যাদা সম্পর্কে অনেক সহিহ হাদিস রয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রমজান মাস এলে রাসূল (সা.) বলতেন, ‘হে জনমণ্ডলী! তোমাদের কাছে মহিমান্বিত রমজান এসে পড়েছে। এ মাস খুবই বরকতময়। এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। আর জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এ মাসে এমন একটি রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বিরত হয়, সে প্রকৃতপক্ষেই হতভাগ্য। (মুসনাদে আহমাদ : ৭১০৮; সুনানে নাসায়ি : ২১০৬)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সঙ্গে কদরের রাতে ইবাদত করবে আল্লাহ তায়ালা তার পেছনের জীবনের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। (বুখারি : ৩৫; মুসলিম : ৭৬০ ও ১২৬৮)।

লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য নবীজি (সা.) শেষের দশ দিন ইতিকাফ করতেন। হজরত আয়শা (রা.) বলেন, ‘ওফাতের আগ পর্যন্ত প্রত্যেক রমজানের শেষের দশ দিন রাসূল (সা.) ইতিকাফ করতেন।’ (বুখারি : ২৩২৬, মুসলিম : ১১৭২)। ‘কিন্তু তিনি যে বছর ওফাত পান, সে বছর বিশ দিন ইতিকাফ করেন।’ (বুখারি : ৪৯৯৮)। ‘রাসূল (সা.) এর ওফাতের পর তাঁর স্ত্রীরা ইতিকাফ করতেন। (বুখারি : ২০২৬, তিরমিজি : ৭৯০।) সুতরাং নারী-পুরুষ সবার উচিত সাধ্য অনুযায়ী লাইলাতুল কদর খোঁজ করা। এ উদ্দেশ্যে ইতিকাফ করা খুবই পুণ্যের কাজ।