জীবন সংক্রান্তি

নিউজ ডেস্ক

সময় একাত্তর

প্রকাশিত : ০২:৩০ পিএম, ২৬ এপ্রিল ২০২১ সোমবার

ছবি : সংগৃহীত

ছবি : সংগৃহীত

কোথায় যেন কি পুড়ে যাচ্ছে। ঝাঁঝালো একটা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। কখনো মনে হচ্ছে গন্ধটা মিলিয়ে যাচ্ছে আবার যেন নাকে এসে লাগছে। 

শাহেদ বসে আছে বারান্দায়। গন্ধটা কি তাদের রান্না ঘর থেকেই আসছে? উঠে গিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে না। মিলিকে ডেকে বলা যায়। মিলি রেগে যেতে পারে। মিলির রাগ ইদানিং কিছুটা বেড়েছে। আগেও রাগ ছিল। তবে তখনকার রাগে ছেলেমানুষি ব্যাপারটা বেশি ছিল। এখন কিছুটা ঝগড়াটে ভাব চলে আসছে তার রাগগুলোতে। 

গতবছর লকডাউনে অফিস বন্ধ হয়ে গেল, শাহেদের বেতন কমে গেল। মিলি খুব রাগারাগি করলো। শাহেদের কোম্পানিকে এক হাত দেখে নিল। কি কোম্পানিতে চাকরি করো তুমি। কয়েকদিনের লকডাউনে একেবারে পথে বসে গেল! সারাবছর ব্যবসা করলো দুইমাস বন্ধ থাকায় বেতন কমিয়ে দিতে হলো! আর তোমারতো বন্ধও ছিল না। লকডাউনের মাঝেও অফিসে গেছো মাঝে মধ্যে। আচ্ছা লকডাউনের জন্য বেতন না হয় কমিয়ে দিলো কিন্তু ঈদের বোনাসটা দিল না কেন?  ঈদতো আর প্রতি মাসে হয় না। বারো মাসের পাওনা দুই মাস লকডাউনে বাতিল হয়ে গেল? কোম্পানির কর্তা ব্যক্তিদের নিয়ে আরো কিছু ছেলেমানুষি কথা বললো মিলি। 

শাহেদকেও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অনেক কথা বললো যেগুলো মনের মধ্যে খুব করে লাগে। ওগুলোকেও মিলির  ছেলেমানুষি হিসেবে নেয়ার চেষ্টা করেছে শাহেদ। কিন্তু ইদানিং যেন আর পারছে না। হতে পারে তার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে নয়তো মিলির রাগগুলো আর ছেলেমানুষির মধ্যে থাকছে না। 

কয়েকদিন যাবৎ এবরশনের জন্য খুব চাপাচাপি করছে মিলি। অবশ্য এবরশনের প্রয়োজন হয়তো হবে না। খুব বেশিদিন হয়নি। ডাক্তারের সাথে কথা বলে ওষুধ টুষুধ খেলেই হয়তো চলবে। শাহেদ বলেছে এসবের দরকার কি? যে শিশু আসছে সে তার রিজিক নিয়েই আসবে। মিলি বললো, তোমাকেতো বলেছিই, বেশিদিন যেহেতু হয়নি মসজিদের কোন ইমাম বা কোনো হুজুরের সাথে কথা বলে দেখো। আর রিজিকের কথা বলছো। রিজিকতো সবাই নিয়ে আসে। কারো রিজিক যোগাড় হয় ভিক্ষা করে কারো চুরি করে। ফকিরও রিজিক নিয়ে জন্মায়। আর খুব পাপ পূন্যের কথা ভাবছো যে, এবরশন না করলে কি সোজা বেহেশতে চলে যাবে নাকি তুমি? দোযখে এমনিতেও যাবে, এবরশনের জন্য হয়তো কয়েকদিন বেশি থাকতে হবে এই আরকি। 

মিলির গলার আওয়াজ বাড়তে থাকায় শাহেদ আর কথা বাড়ায়নি। তাছাড়া কি আর বলবে এমন। মিলি হয়তো তর্কের খাতিরে রিজিক নিয়ে কিছু কথা বলেছে। সেভাবে রিজিকের ব্যাপারটা অস্বীকারও করেনি। তার মনে হয় এ নিয়ে সেই মিলির চেয়ে বেশি সমস্যায় আছে। স্রষ্টা, সৃষ্টি, ধর্ম নিয়ে তার মনে এমন এমন প্রশ্ন আসে যেগুলো কোন ধার্মিকের মনে আসা ঠিক নয়। তবুও তার মনে চলে আসে। সে না চাইলেও চলে আসে। মাঝে মাঝে সে শঙ্কিত বোধ করে। সে কি মোনাফেক হয়ে যাচ্ছে? ধর্ম যেটুকু আছে শুধু চাল চলন আর সামাজিকতায়? মনের গভীর থেকে ধর্মের ব্যাপারটা মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে? যদি মুছে যেতে থাকে, স্রষ্টা যদি মোনাফেকের তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করতে চায় সেক্ষেত্রে কি তার কিছু করার আছে। 

এই ভাবনাগুলো সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চায় না শাহেদ। তার অনিচ্ছাতেও অবচেতন মন ভাবনাগুলো চালিয়েই যায়। সে ভাবনাগুলো অন্যদিকে নেয়ার চেষ্টা করে। বেতন কমে যাওয়াতে কি কি প্রভাব পড়েছে ভাবার চেষ্টা করে। এবরশন করানোর পেছনে কি আর্থিক কারণটা খুব বেশি কাজ করছে? বেতন স্বাভাবিক থাকলে কি এবরশনের প্রশ্নটা আসতো না? 

জামির বয়স ১৫ মাস। এই অবস্থায় আবার একটি নতুন শিশু মিলির জন্য এমনিতেও অনেক চাপের হয়ে যেতো। বেতন কমে যাওয়াতে হয়তো বারবার এই কারণটা সামনে চলে আসছে। বেতন কমাতে কি তাদের দৈনন্দিন জীবনে তেমন কোন পরিবর্তন এসেছে? মিলি কখনও মাছ মাংস খেতো না সেভাবে। মাছ মাংস দুটোতেই নাকি তার বমি আসে। আগে ব্যাপারটা স্বাভাবিকই ছিল শাহেদের কাছে। কিন্তু ইদানিং ব্যাপারটা খুব চোখে লাগে। মনে হয় যেন এই টানাটানির মধ্যেও সে দিব্যি মাছ-মাংস খেয়ে যাচ্ছে অথচ মিলি খাচ্ছে না। বাসায় মাছ মাংস আনা বন্ধ করা হলো। 

জামির এখনও সেভাবে ভাত খাওয়ার বয়স হয়নি। বাজারে এখন কতরকমের শিশুখাদ্য পাওয়া যায়। জামিকে বুকের দুধের পাশাপাশি খেতে হচ্ছে শুধু ভাত। এই পরিবর্তনগুলো খুব স্বাভাবিকভাবে হয়েছে যেন এগুলো হওয়ারই কথা ছিল। 

কখনও কখনও গ্রামে ফিরে যাওয়ার কথাও ভাবে শাহেদ। শাহেদের মনে হয়, তার মতো যারা গ্রাম থেকে একবার বের হয় তারা আবার শুধু মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসলেই গ্রামে ফিরতে পারে। এছাড়া গ্রামে ফিরে যাওয়াটা যেন সংসার করতে না পারা গাঁয়ের বধূর মতোই। যার বাপের বাড়িতে ফিরে আসার কথা ছিল না। কিন্তু জীবন থেকে ছিটকে পড়ে তার প্রাণের অধিক প্রিয় বাপের বাড়িতে ফিরে আসতে হয় অনিচ্ছায়, অসম্মানে। গ্রামের কথা মনে এলে শ্রী কৃষ্ণের কথাও মনে পড়ে শাহেদের। শ্রী কৃষ্ণের মনটাও হয়তো কখনও কখনও আকুল হয়ে উঠতো। অসহায় হয়ে ভাবতো তার শৈশবের গ্রাম এবং যমুনার কথা। বাস্তবতা হয়তো তাকে যমুনা পাড়ে ফিরে যেতে দেয়নি। সব মানুষেরই হয়তো গোপন কিছু কষ্ট থাকে যেগুলো ভেবে অতি গোপনে নিজের মনকে শুধু সিক্ত করা যায়, নিজের সাথেই কাঁদা যায়। কিছু করার সুযোগ থাকলেও করা যায় না। নির্মম বাস্তবতার মাঝে অসহায় কারা যাপন করতে করতে হয় দিনের পর দিন।

পোড়া গন্ধের ঝাঁঝটা বাড়ছে ধীরে ধীরে। মিলিকে ডেকে গন্ধের কথাটা বললে কি খুব রেগে যাবে? অবশ্য এখানে রাগ করার যথেষ্ট কারণ আছে। সে ইচ্ছা করলেই রান্না ঘরে উঁকি দিয়ে দেখতে পারে। কিন্তু তার ইচ্ছা করছে না। শুধু তার ইচ্ছা করছে না বলে রান্না ঘরে সামান্য উঁকি দেয়ার কাজটাকে সে অগ্রায্য করতে পারছে। ব্যাপারটাতে সে আরামবোধ করছে।

অফিসে এই সুযোগটা প্রায় নেই বললেই হয়। কাজের বাইরে এমন অনেক কিছু করতে হয় যেগুলো তার ইচ্ছা করে না। বিশেষ করে মানুষের সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। যদি এমন হতো অফিসে শুধু কাজ হবে কোনো কথা বলার প্রয়োজন হবে না। টি জোনে যখন কেউ থাকে না শাহেদ তখন চুপি চুপি চা খেয়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রায় কখনই তা হয়ে উঠে না। 

মানুষজন এসে জমে যায় এবং খোশগল্প শুরু করে দেয়। সেদিন কমার্শিয়াল সেকশানের নাসের সাহেব প্রশ্ন করলেন, করোনার টিকার সাইড ইফেক্ট কেমন। প্রশ্নটা কারো উদ্দেশে করেননি বা জবাব দিতে হবে এমন ভাবেও করেননি। চায়ের কাপে বিস্কুট ডুবাতে ডুবাতে প্রশ্নটা করলেন। তেমন সিরিয়াস কোন প্রশ্ন না। অবশ্য সিরিয়াস হলেও টি জোনে কোন আলোচনাই তেমন সিরিয়াস থাকে না। সব প্রসঙ্গই অনেকটা খোশগল্পের মতো হয়ে যায়।

ইফতেখার সাহেব বললেন, সাইড ইফেক্ট; পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কথা বলছেন আপনি? পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই কিসে বলেন? এই যে আমরা বেঁচে আছি, তারও একটা সাইড ইফেক্ট আছে। প্রতিদিন বেঁচে থাকার জন্য আমাদের চব্বিশ ঘণ্টা করে আয়ু নষ্ট হচ্ছে। ইফতেখার সাহেবের কথার মাঝেই সবাই একযোগে হেসে উঠলো। শাহেদ হাসিতে যোগ দিতে পারেনি। রশিকতাটা বুঝতে তার সময় লেগে গেল। এর মধ্যে সবাই হাসির পর্ব শেষ করে ফেলেছে। তার উচিত ছিল সবাই যখন হেসেছে বুঝে না বুঝে সবার সাথে যোগ দেয়া। ইফতেখার সাহেব সিনিয়র পার্সন। সিনিয়রদের রশিকতায় না হাসা অভদ্রতা আর রশিকতা ধরতে না পারা অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচ্য।    

ফয়সাল সাহেব অনেকটা ইফতেখার সাহেবের দিকে সরে গিয়ে গলার স্বর খাদে নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললেন, বস কোন খবর আছে নাকি? এবারো বেতন বোনাস ডিডাকশান হবে নাকি? ইফতেখার সাহেব ক্ষণিকের জন্য উপস্থিত সবার উপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। এই দৃষ্টির অর্থ হলো এসব আলোচনা এভাবে সবার সামনে করা যায় না। এই দৃষ্টি উপস্থিত জুনিয়রদের জন্য অস্বস্তিদায়ক।

নাসের সাহেব বললেন, বেতন ডিডাকশান হলে সমস্যা কি, ত্রাণের ব্যবস্থা আছে, প্রণোদনার ব্যবস্থা আছে।

ফয়সাল সাহেব বললেন, আপনি ত্রাণ, প্রণোদনা কোন ক্যাটাগরিতে পড়েন?

শাহেদ বলল, রিটার্ন জমা দেয়ার সময়ও আমাদের লাইন ধরে টাকা দিয়ে আসতে হয়, ত্রাণ নেয়ার সময়ও লাইন ধরতে হয়। শাহেদ কথাটা বলল আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য বা কিছু একটা বলতে হয় এজন্য। কথাটা বলে তার নিজেরই মনে হলো কথাটা ঠিক খাপ খায়নি। এমনিতেই শাহেদ ভিতরে ভিতরে গুটিয়ে যাচ্ছিল তার উপর ফয়সাল সাহেব বলে বসলেন, শাহেদ সাহেব আপনিতো জিরো রিটার্ন জমা দিয়েছেন তাইনা, বলছেন যে লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা দিয়েছেন। আবার একটা হাসির রোল উঠছিল। এই যাত্রায় শাহেদকে উদ্ধার করলো নাসের সাহেব। নাসের সাহেব বললেন, ফয়সাল ভাই ওনি আয়কর না হয় জিরো রিটার্ন জমা দেন কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভ্যাটতো দিচ্ছেন।

সন্ধ্যা মিলিয়ে আসছে। শাহেদ বারান্দাতেই বসে আছে। পোড়া গন্ধটা এখন আর তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। শাহেদ বাইরে তাকিয়ে সন্ধ্যার আলো কিভাবে ধীরে ধীরে অন্ধকারে প্রবেশ করছে দেখছে। আজ রাতে বোধহয় বড় একটা চাঁদ উঠবে আকাশে। পাখির কিচিরমিচির শব্দে ভোর হবে। আজকাল ভোরগুলো এতো সুন্দর হয়! শুভ্র ভোরের আলোয় সূর্যটা এমন ঝলমলিয়ে উঠে যে দেখে বুঝার কোন উপায় থাকেনা আশ্চর্য সুন্দর এই পৃথিবীটাকে কী এক অদৃশ্য জীর্ণতা গ্রাস করে রেখেছে।