আল্লাহর জন্য বহু বচন ব্যবহারের তাৎপর্য

নিউজ ডেস্ক

সময় একাত্তর

প্রকাশিত : ০৩:১৬ পিএম, ২৭ মে ২০২১ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৩:১৮ পিএম, ২৭ মে ২০২১ বৃহস্পতিবার

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

শব্দকে তার নিজস্ব অর্থে ব্যবহার না করে ভিন্ন অর্থে প্রয়োগ করা হলে বাড়তি মর্ম পাওয়া যায়। এটি ভাষার একটি স্বীকৃত বিষয়। শের বা বাঘ শব্দটি গঠিত হয়েছে বনের একটি জন্তুর নাম হিসেবে। বন্য সেই জন্তুকে বোঝানো হলো এর নিজস্ব অর্থ। কিন্তু যখন শব্দটি এই অর্থে ব্যবহার না হয়ে মানুষকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয় ‘শেরে বাংলা’ বা বাংলার বাঘ বলে, তখন বাড়তি যে মর্ম তাতে যোগ হয় তা হলো মানুষটির ভেতরে আছে শক্তি ও সাহসিকতা।

আরবি ভাষায় ‘নাহনু’ মানে আমরা। এটি দুজন বা একাধিকজনের জন্য গঠিত একটি সর্বনাম। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে একে নিজস্ব অর্থ থেকে সরিয়ে এক বচনের জন্য যখন ব্যবহার করা হয় তখন বাড়তি যে মর্ম তাতে স্থান করে নেয় তা হলো, ব্যক্তির মর্যাদাবান ও সম্মানিত হওয়া।

বিখ্যাত আরবি অভিধান ‘আল-মুজামুল ওয়াসিত’-এর লেখক বলেন, ‘সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বহু বচনের শব্দকে একজনের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে।’

সম্মানের প্রশ্নে আল্লাহ তাআলা হলেন সবার চেয়ে অগ্রগামী। তিনি একক ও অংশীদারবিহীন। কোরআনে অনেক আয়াতে আল্লাহর জন্য বহু বচনের শব্দ ব্যবহৃত হওয়ার একটি প্রধান কারণ হলো, এটি সম্মান, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি প্রকাশ করে।

প্রশ্ন হলো, যেখানে এক বচনের শব্দ ব্যবহৃত হয় সেখানে কি তাঁর সম্মান-মর্যাদা ও প্রতিপত্তি থাকে না? কোথায় এক বচনের শব্দ আর কোথায় বহু বচনের শব্দ ব্যবহার করা হয় আল্লাহর জন্য? এই লেখাতে আমরা জিজ্ঞাসাগুলোর জবাব খোঁজার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।

এই বিষয়টি বোঝার জন্য মোটাদাগে যে মূলনীতি মাথায় রাখা যেতে পারে তা হলো, আল্লাহ তাআলা নিজের পরিচয়সংক্রান্ত আলোচনায় সব সময় এক বচনের শব্দ ব্যবহার করেন। কেননা মূলত পরিচয়ের প্রশ্নে তিনি একক সত্তা। সেখানে কোনো শরিক নেই। তাঁর কোনো সন্তান বা মা-বাবা নেই। তিনি যেমন কারো থেকে জন্ম নেননি, তেমনি কাউকে জন্মও দেননি। তাই এই ক্ষেত্রে এক বচন উল্লেখ করাই যথার্থতার দাবি। যেমন—কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ, আমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই।’

পক্ষান্তরে যেখানে তিনি স্বীয় কর্মের কথা উল্লেখ করেন সেখানে সাধারণত বহু বচনের শব্দ উল্লেখ করেন। যেন তাঁর মর্যাদা, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি প্রকাশিত হয়। যেমন—‘এবং আমরা (আমি) তোমাদের ওপর মজবুত সাতটি আসমান নির্মাণ করেছি।’ (সুরা নাবা, আয়াত : ১২)

মোটাদাগের কথাটি জানার পর এবার আমরা একে আরেকটু সবিস্তারে জানব।

মর্যাদা, সম্মান, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, বড়ত্ব, মহানুভবতা, দয়া, দান ইত্যাদি ক্ষেত্রে এক বচন ও বহু বচন দুটিই ব্যবহার করা হয়। কারণ এই কর্মগুলো দুই ধরনের—

১. যা সম্পাদনার ক্ষেত্রে আল্লাহই একমাত্র সত্তা। তিনি এটি নিজেই সম্পাদন করেন। এর সঙ্গে অন্য কেউ সম্পৃক্ত হয় না। যেমন—ক্ষমা করা, দোয়া কবুল করা, অদৃশ্যের সংবাদ জানা ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে বেশির ভাগ জায়গায় এক বচন ব্যবহার করা হয়।

কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং নিশ্চয়ই আমি যারা তাওবা করে তাদের বারবার ক্ষমা করি।’ (সুরা ত্বহা, আয়াত : ৮২)

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘এবং তোমাদের রব বলেছেন, আমাকে ডাকো। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’ (সুরা গাফির, আয়াত : ৬০)

২. যা মূলত আল্লাহ তাআলা সম্পাদন করলেও তিনি সেটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব অন্য কাউকে দান করেন। তাঁর নির্দেশনা অনুপাতে তারা সেটি করে থাকে। কিংবা কোনো বস্তুর মাধ্যমে তিনি কাজের বাস্তবায়ন ঘটান। এসব কাজের বাস্তব রূপায়ণে অন্যদের অংশগ্রহণ থাকলেও মূল ভূমিকা আল্লাহরই এবং তাঁর নির্দেশনামা মেনেই অন্যরা সেগুলো পালন করে। এসব ক্ষেত্রে বেশির ভাগ জায়গায় বহু বচন ব্যবহার করা হয়।

কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা (আমি) কোরআন নাজিল করেছি এবং আমরাই (আমিই) তাকে হিফাজত করব।’ (সুরা হিজর, আয়াত : ০৯)

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘এবং আমরা (আমি) আদমসন্তানকে সম্মানিত করেছি। আমরা (আমি) তাদের বাহন দিয়েছি জলে ও স্থলে...।’ (সুরা ইসরা, আয়াত : ৭০)

তবে এই জাতীয় কর্ম যেহেতু মূলত আল্লাহই ঘটান সেটা বোঝানোর জন্য এক বচনের শব্দেও আসতে পারে; কিন্তু সেটা তুলনামূলক কম। যেমন—‘আমাকে ও আমি এককভাবে যা সৃষ্টি করেছি তাকে ছেড়ে দাও।’ (সুরা মুদ্দাসসির, আয়াত : ১১)

আল্লাহর পরিচয়, ইবাদতের নির্দেশনা, তাওহিদ সাব্যস্ত করা, শিরককে নাকচ করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সর্বদা  এক বচনের শব্দ ব্যবহৃত হয়। কারণ এই বিষয়গুলোর এটিই যথার্থ দাবি। যেমন—‘তোমরা আমার সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না।’ (সুরা হজ, আয়াত : ২৬)

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘এবং আমি মানুষ ও জিনকে সৃষ্টি করেছি শুধু আমার ইবাদত করার জন্য।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত : ৫৬)

তবে একটি বিষয় স্মরণ রাখতে হবে। তা হলো, বিভিন্ন উপযোগিতার বিবেচনায় যদিও কিছু আয়াতে আল্লাহর জন্য বহু বচনের শব্দ ব্যবহার করা হয়; কিন্তু এর আগে-পরে সাধারণত এমন কোনো কিছু থাকে, যা আল্লাহর একক হওয়ার প্রমাণ বহন করে। যেমন—সুরা কাউসারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা (আমি) আপনাকে কাউসার দান করেছি। সুতরাং আপনি আপনার রবের জন্য সালাত আদায় করুন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা কাউসার, আয়াত : ১-২)

এই আয়াতে প্রথমে বহু বচনে দান করার কথা বলা হলেও পরক্ষণেই এক বচনে ‘রব’ শব্দ আনা হয়েছে। এর দ্বারা আগের আয়াতে আলোচিত দাতাকেই বোঝানো হয়েছে। ফলে আর কোনো সংশয় থাকে না যে উক্ত দাতা একক সত্তা, একাধিকজন নন।

এমনই আরেকটি উদাহরণ সুরা ফাতহের এই আয়াত থেকেও দেখা যেতে পারে—‘নিশ্চয়ই আমরা (আমি) আপনাকে স্পষ্ট বিজয় দান করেছি, যেন আল্লাহ আপনার আগে-পরের সব পাপ মাফ করে দেন এবং আপনার ওপর তাঁর নিয়ামত পূর্ণ করেন ও আপনাকে সঠিক পথ দেখান।’ (সুরা ফাতহ, আয়াত : ১-২)

মহান আল্লাহ আমাদের অনুধাবন করার তাওফিক দান করুন।