দাজ্জালের আক্রমণ ও সুরা কাহফের আমলের সম্পর্ক কী?

ইসলাম ডেস্ক

সময় একাত্তর

প্রকাশিত : ১০:২২ এএম, ১৪ এপ্রিল ২০২২ বৃহস্পতিবার

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

ক্ষমার দশকের দ্বিতীয় তারাবি পড়া হবে আজ। হাফেজে কোরআনদের কণ্ঠে তেলাওয়াত হবে ঘটনাবহুল প্রসিদ্ধ দুইটি সুরা। আজকের তেলাওয়াত শুনে মুগ্ধ ও পরিতৃপ্ত হবে রোজাদার। সুরাটিতে রয়েছে শিক্ষণীয় বিশেষ কিছু ঘটনা ও দোয়া। যা মুমিন রোজাদারের অন্তরকে আলোকিত করে তুলবে। দাজ্জালের ফেতনা থেকে বেঁচে থাকার সঙ্গে সুরা কাহফের তেলাওয়াতের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এ বিষয়টিসহ সুরা দুইটিতে আলোচিত দোয়া ও উপলক্ষগুলো তুলে ধরা হলো।

 ক্ষমার দশকে রোজাদার প্রার্থনায় মনোযোগী হবে। নিজেদের ঈমানকে মজবুত করবে। আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলবে। এ সবের বর্ণনাই পড়া হবে আজ। বাবা-মায়ের জন্য রহমতের দোয়া করা হবে। জালেম বাদশার আক্রমণে ৭ যুবকের আশ্রয় প্রার্থনার বিষয়টও পড়া আজ।

রমজানের ১২ তারাবিতে কোরআনের ১৭ ও ১৮তম সুরা 'সুরা বনি ইসরাইল ও সুরা কাহফ'-এর ৭৪ আয়াত পর্যন্ত পড়া হবে। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেরাজের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শুরু করে হজরত খিজির আলাইহিস সালাম কর্তৃক শিশু হত্যার ঘটনা দিয়ে শেষ হবে তারাবি।

মেরাজ

ইসলামের ইতিহাস ও বিশ্বনবির জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় মেরাজ। এটি বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের অনেক বড় মুজিজাও এটি। তারাবি নামাজের প্রথম রাকাআতে পড়া হবে মেরাজের বর্ণনা। কোরআনুল কারিমে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেরাজ সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-

 سُبۡحٰنَ الَّذِیۡۤ اَسۡرٰی بِعَبۡدِهٖ لَیۡلًا مِّنَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ اِلَی الۡمَسۡجِدِ الۡاَقۡصَا الَّذِیۡ بٰرَکۡنَا حَوۡلَهٗ لِنُرِیَهٗ مِنۡ اٰیٰتِنَا ؕ اِنَّهٗ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ

‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে (সে রাতে) আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ০১)

নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়ত পাওয়ার ১১তম বছরের কোনো এক রাতে ঐতিহাসিক মেরাজের এ ঘটনা ঘটে। অনেকে ২৬ রজব দিবাগত রাতের কথা বলে থাকেন। সেই সময়ে তা ছিল সৃষ্টিজগতের সেরা আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঐতিহাসিক ঘটনা।

মেরাজের আশ্চর্যজনক ও তৎপর্যপূর্ণ ঘটনায় বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মান ও উচ্চ মর্যাদাই প্রকাশ পেয়েছে। মেরাজের এ ঘটনায় বিশ্বাস স্থাপন করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য তার আক্বিদা-বিশ্বাসের অংশও বটে। মেজারে ঘটনায় মুসলিম উম্মাহর জন্য রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। বিশ্বনবির মেরাজ নিয়ে আছে হাদিসের সুস্পষ্ট নির্দেশনা।

সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ১-১১১

সুরা বনি ইসরাইল পবিত্র নগরী মক্কায় নাজিল হয়। সুরাটি ১২ রুকু ও ১১১ আয়াতে সন্নিবেশিত। যদিও সুরার নাম বনি ইসরাইল কিন্তু বনি ইসরাইল এ সুরার আলোচ্য বিষয় নয়। বরং প্রতীকী হিসেবে নামটি সুরার চার নম্বর আয়াত থেকে নেয়া হয়েছে। এ সুরার প্রথম আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, সুরাটি মিরাজের সময় নাজিল হয়েছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী হিজরতের এক বছর আগে এ সুরাটি নাজিল হয়।

সুরাটি মুসলি উম্মাহর জন্য সতর্কবার্তা। মক্কার কাফের অবিশ্বাসীদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে, বনি ইসরাইল ও অন্যান্য জাতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো। আল্লাহর দেওয়া অবকাশ তথা সময় শেষ হয়ে আসছে তা শেষ হওয়ার আগেই নিজেদের সামলে নাও।

মানুষকে সৎ পথে চলার জন্য নসিহত করা হয়েছে। আবার ভালো-মন্দ কাজে যার যার আমলনামা তাকেই পড়তে হবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে এ সুরায়। বিষয়টি আল্লাহ তাআলা এভাবে তুলে ধরেন-

 اِقۡرَاۡ کِتٰبَکَ ؕ کَفٰی بِنَفۡسِکَ الۡیَوۡمَ عَلَیۡکَ حَسِیۡبًا -  مَنِ اهۡتَدٰی فَاِنَّمَا یَهۡتَدِیۡ لِنَفۡسِهٖ ۚ وَ مَنۡ ضَلَّ فَاِنَّمَا یَضِلُّ عَلَیۡهَا ؕ وَ لَا تَزِرُ وَازِرَۃٌ وِّزۡرَ اُخۡرٰی ؕ وَ مَا کُنَّا مُعَذِّبِیۡنَ حَتّٰی نَبۡعَثَ رَسُوۡلًا

'পাঠ কর তুমি তোমার কিতাব (আমল)। আজ তোমার হিসাব গ্রহণের জন্যে তুমিই যথেষ্ট। যে কেউ সৎপথে চলে, তারা নিজের মঙ্গলের জন্যেই সৎ পথে চলে। আর যে পথভ্রষ্ট হয়, তারা নিজের অমঙ্গলের জন্যেই পথ ভ্রষ্ট হয়। কেউ অপরের বোঝা বহন করবে না। কোনো রাসুল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ১৪-১৫ 

হজরত হাসান বসরি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, 'আল্লাহর শপথ করে বলছি, যিনি তোমার হিসাবের ভার তোমার কাছেই অৰ্পণ করেছেন তিনি অবশ্যই তোমার সঙ্গে সবচেয়ে বড় ইনসাফের কাজ করেছেন।' (ইবনে কাসির)

হজরত কাতাদাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, 'সেদিন সবাই তাদের আমলনামা পড়তে পারবে। যদিও সে দুনিয়াতে নিরক্ষর ছিল।' (তাবারি)

সৎ ও সত্য-সঠিক পথে চলে কোনো ব্যক্তি আল্লাহ, রাসুল বা সংশোধন প্রচেষ্টা পরিচালনাকারীদের প্রতি কোনো অনুগ্রহ করে না বরং সে তার নিজেরই কল্যাণ করে। অনুরূপভাবে ভুল পথ অবলম্বন করে অথবা তার উপর অনড় থেকে কোনো ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করে না, নিজেরই ক্ষতি করে।' (আদওয়াউল বায়ান)

আল্লাহর রাসুল ও সত্যের আহবায়কগণ মানুষকে ভুল পথ থেকে বাঁচাবার এবং সঠিক পথ দেখাবার জন্য যে প্রচেষ্টা চালান তা নিজের কোনো স্বার্থে নয়, বরং মানবতার কল্যাণার্থেই। কোরআনের অন্যত্রও আল্লাহ তাআলা তা বলেছেন-

مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفۡسِهٖ وَ مَنۡ اَسَآءَ فَعَلَیۡهَا ؕ وَ مَا رَبُّکَ بِظَلَّامٍ لِّلۡعَبِیۡدِ

যে সৎকর্ম করে সে তার নিজের জন্যই তা করে। আর যে অসৎকর্ম করে তা তার উপরই বর্তাবে। তোমার রব তাঁর বান্দাদের প্রতি মোটেই অত্যাচারী নন।' (সুরা ফুসসিলাত : আয়াত ৪৬)

مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفۡسِهٖ ۚ وَ مَنۡ اَسَآءَ فَعَلَیۡهَا ۫ ثُمَّ اِلٰی رَبِّکُمۡ تُرۡجَعُوۡنَ

'যে সৎকর্ম করে, সে তার নিজের জন্যই তা করে এবং যে মন্দকর্ম করে তা তার উপর বর্তাবে। তারপর তোমরা তোমাদের রবের প্রতি প্রত্যাবর্তিত হবে।' (সুরা আল-জাসিয়াহ : আয়াত ১৫)

এর পর এ সুরায় মহান আল্লাহর ইবাদত ও বাবা-মায়ের আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ। আল্লাহর ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মায়ের প্রতি উত্তম ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আবার বাবা-মা জন্য দোয়া শেখানো হয়েছে এ সুরায়। আল্লাহ তাআলা বলেন-

 وَ قَضٰی رَبُّکَ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ وَ بِالۡوَالِدَیۡنِ اِحۡسَانًا ؕ اِمَّا یَبۡلُغَنَّ عِنۡدَکَ الۡکِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ اَوۡ کِلٰهُمَا فَلَا تَقُلۡ لَّهُمَاۤ اُفٍّ وَّ لَا تَنۡهَرۡهُمَا وَ قُلۡ لَّهُمَا قَوۡلًا کَرِیۡمًا

'তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে `উহ' শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ২৩)

 وَ اخۡفِضۡ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحۡمَۃِ وَ قُلۡ

'তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল-

رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا

উচ্চারণ : 'রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা'

অর্থ : 'হে আমার প্রভু! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমনিভাবে তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ২৪)

আত্মীয়-স্বজন গরিব-দুঃখী ও মুসাফিরকে দান করার নির্দেশের পাশাপাশি মানুষকে অপচয় থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এ সুরায়। কেননা অপচয়কারীদের শয়তানের ভাই হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন-

وَ اٰتِ ذَاالۡقُرۡبٰی حَقَّهٗ وَ الۡمِسۡکِیۡنَ وَ ابۡنَ السَّبِیۡلِ وَ لَا تُبَذِّرۡ تَبۡذِیۡرًا -  اِنَّ الۡمُبَذِّرِیۡنَ کَانُوۡۤا اِخۡوَانَ الشَّیٰطِیۡنِ ؕ وَ کَانَ الشَّیۡطٰنُ لِرَبِّهٖ کَفُوۡرًا

'আত্মীয়-স্বজনকে তার হক দান কর এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও। এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ২৬-২৭)

আল্লাহ তাআলা মানুষকে যেমন জীবিকা দান করেন আবার তাদের জীবিকা সংকুচিতও করে দেন তিনি। অভাবের সন্তান হত্যা করার মারাত্মক পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এ সুরায়। ব্যভিচার ও হত্যার মতো জঘন্য পাপ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন-

اِنَّ رَبَّکَ یَبۡسُطُ الرِّزۡقَ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ یَقۡدِرُ ؕ اِنَّهٗ کَانَ بِعِبَادِهٖ خَبِیۡرًۢا بَصِیۡرًا -  وَ لَا تَقۡتُلُوۡۤا اَوۡلَادَکُمۡ خَشۡیَۃَ اِمۡلَاقٍ ؕ نَحۡنُ نَرۡزُقُهُمۡ وَ اِیَّاکُمۡ ؕ اِنَّ قَتۡلَهُمۡ کَانَ خِطۡاً کَبِیۡرًا  -  وَ لَا تَقۡرَبُوا الزِّنٰۤی اِنَّهٗ کَانَ فَاحِشَۃً ؕ وَ سَآءَ سَبِیۡلًا - وَ لَا تَقۡتُلُوا النَّفۡسَ الَّتِیۡ حَرَّمَ اللّٰهُ اِلَّا بِالۡحَقِّ ؕ وَ مَنۡ قُتِلَ مَظۡلُوۡمًا فَقَدۡ جَعَلۡنَا لِوَلِیِّهٖ سُلۡطٰنًا فَلَا یُسۡرِفۡ فِّی الۡقَتۡلِ ؕ اِنَّهٗ کَانَ مَنۡصُوۡرًا

'নিশ্চয় তোমার পালকর্তা যাকে ইচ্ছা অধিক জীবনোপকরণ দান করেন এবং তিনিই তা সংকুচিতও করে দেন। তিনিই তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত,-সব কিছু দেখছেন। দারিদ্রের ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমিই জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি। নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা মারাত্নক অপরাধ। আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। সে প্রাণকে হত্যা করো না, যাকে আল্লাহ হারাম করেছেন; কিন্তু ন্যায়ভাবে। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয়, আমি তার উত্তরাধিকারীকে ক্ষমতা দান করি। অতএব, সে যেন হত্যার ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘন না করে। নিশ্চয় সে সাহায্যপ্রাপ্ত।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৩০-৩৩)

দ্রব্যসামগ্রী মাফে বা ওজনে কম দিলে আল্লাহ তাআলা মানুষের ওপর দুর্যোগ ও বালা-মুসিবত চাপিয়ে দেন বলেছেন বিশ্বনবি। কোরআনুল কারিমের এ সুরায় আল্লাহ তাআলা মানুষকে সঠিক উপায়ে মাফ দেয়ার কথা বলেছেন। আল্লাহ বলেন-

وَ اَوۡفُوا الۡکَیۡلَ اِذَا کِلۡتُمۡ وَ زِنُوۡا بِالۡقِسۡطَاسِ الۡمُسۡتَقِیۡمِ ؕ ذٰلِکَ خَیۡرٌ وَّ اَحۡسَنُ تَاۡوِیۡلًا

'মেপে দেয়ার সময় পূর্ণ মাপে দেবে এবং সঠিক দাঁড়িপালায় ওজন করবে। এটা উত্তম; এর পরিণাম শুভ। (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৩৫)

আল্লাহ তাআলা মানুষকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেন যে, তোমদের হাড়-অস্থি যদি মাটির সঙ্গে মিশেও যায়, আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদের জীবিত করবেন। তিনি তাতে সক্ষম। যে বিষয়ে অবিশ্বাসীরা প্রশ্ন তুলেছিল। আল্লাহ তাআলা সে বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন-

'তারা বলে, যখন আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাব, তখনও কি নতুন করে সৃষ্টি হয়ে উঠবো? (হে নবি আপনি) বলুন, তোমরা পাথর হয়ে যাও কিংবা লোহা। অথবা এমন কোন বস্তু, যা তোমাদের ধারণায় খুবই কঠিন। তথাপি তারা বলবেঃ,আমাদের পুনরায় কে সৃষ্টি করবে? (হে রাসুলঃ! আপনি) বলুন, যিনি প্রথমবার তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। অতঃর তারা আপনার সামনে মাথা নাড়বে এবং বলবে, এটা কবে হবে? বলুন, হবে, সম্ভবত খুব শিগগিরই।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৪৯-৫১)

এ সুরায়ও হজরত আদম আলাইহিস সালামের সৃষ্টি ও তাকে সেজদার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। যা করতে শয়তান অস্বীকার করেছিল। এ সুরায় মানুষের অকৃতজ্ঞতার বিষয়টি ওঠে এসেছে। যখন বিপদ থেকে উদ্ধার করার পর তারা সে বিষয় অস্বীকার করে। আল্লাহ বলেন-

وَ اِذَا مَسَّکُمُ الضُّرُّ فِی الۡبَحۡرِ ضَلَّ مَنۡ تَدۡعُوۡنَ اِلَّاۤ اِیَّاهُ ۚ فَلَمَّا نَجّٰىکُمۡ اِلَی الۡبَرِّ اَعۡرَضۡتُمۡ ؕ وَ کَانَ الۡاِنۡسَانُ کَفُوۡرًا

'যখন সমুদ্রে তোমাদের উপর বিপদ আসে, তখন শুধু আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তোমরা ডাকো তাদেরকে তোমরা ভুলে যাও। এরপর তিনি (আল্লাহ) যখন তোমাদের স্থলে ভিড়িয়ে উদ্ধার করে নেন, তখন তোমরা (আবার) মুখ ফিরিয়ে নাও। মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৬৭)

মানুষকে নামাজের সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন মহান আল্লাহ। যাতে মানুষ যথা সময়ে নামাজ আদায় করতে পারে। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-

 اَقِمِ الصَّلٰوۃَ لِدُلُوۡکِ الشَّمۡسِ اِلٰی غَسَقِ الَّیۡلِ وَ قُرۡاٰنَ الۡفَجۡرِ ؕ اِنَّ قُرۡاٰنَ الۡفَجۡرِ کَانَ مَشۡهُوۡدًا - وَ مِنَ الَّیۡلِ فَتَهَجَّدۡ بِهٖ نَافِلَۃً لَّکَ ٭ۖ عَسٰۤی اَنۡ یَّبۡعَثَکَ رَبُّکَ مَقَامًا مَّحۡمُوۡدًا

'সূর্য ঢলে পড়ার সময় থেকে রাত্রির অন্ধকার পর্যন্ত নামাজ প্রতিষ্ঠা করুন আর ফজরের কোরআন পাঠও। নিশ্চয় ফজরের কোরআন পাঠ মুখোমুখি হয়। রাত্রির কিছু অংশ কোরআন পাঠসহ (তাহাজ্জুদে) জাগ্রত থাকুন। এটা আপনার জন্যে অতিরিক্ত। হয়ত বা আপনার পালনকর্তা আপনাকে মর্যাদাসম্পদন্ন উচ্চ স্থানে পৌঁছাবেন।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৭৮-৭৯)

সত্যবাদী হওয়ার ও রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার আবেদন

এ সুরায় গুরুত্বপূর্ণ আবেদন ও প্রার্থনা ওঠে এসেছে। যে প্রার্থনায় রয়েছে মানুষের সত্যবাদী হওয়ার আবেদন। রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা লাভের আবেদন। আর তাহলো-

رَّبِّ أَدْخِلْنِي مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِجْنِي مُخْرَجَ صِدْقٍ وَاجْعَل لِّي مِن لَّدُنكَ سُلْطَانًا نَّصِيرًا

উচ্চারণ : 'রাব্বি আদখিলনি মুদখালা সিদকিও ওয়া আখরিঝনি মুখরাঝা সিদকিও ওয়াঝআললি মিল্লাদুংকা সুলতানান নাসিরা।'

অর্থ : 'হে পালনকর্তা! আমাকে দাখিল করুন সত্যরূপে এবং আমাকে বের করুন সত্যরূপে এবং দান করুন আমাকে নিজের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় সাহায্য।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৮০)

আল্লাহ তাআলা এ কোরআনে রোগের চিকিৎসা ও নেয়ামত দান করেছেন। অথচ বান্দা আল্লাহকে ছাড়া অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ نُنَزِّلُ مِنَ الۡقُرۡاٰنِ مَا هُوَ شِفَآءٌ وَّ رَحۡمَۃٌ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ ۙ وَ لَا یَزِیۡدُ الظّٰلِمِیۡنَ اِلَّا خَسَارًا  - وَ اِذَاۤ اَنۡعَمۡنَا عَلَی الۡاِنۡسَانِ اَعۡرَضَ وَ نَاٰ بِجَانِبِهٖ ۚ وَ اِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ کَانَ یَــُٔوۡسًا

'আমি কোরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত। গুনাহগারদের তো এতে শুধু ক্ষতিই বৃদ্ধি পায় আমি মানুষকে নেয়ামত দান করলে সে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং অহংকারে দুরে সরে যায়; যখন তাকে কোনো অনিষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে একেবারে হতাশ হয়ে পড়ে।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৮২-৮৩)

সুরাটির শেষ আয়াতে আল্লাহ নিজের পরিচয় ও অংশীদারিত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন-

وَ قُلِ الۡحَمۡدُ لِلّٰهِ الَّذِیۡ لَمۡ یَتَّخِذۡ وَلَدًا وَّ لَمۡ یَکُنۡ لَّهٗ شَرِیۡکٌ فِی الۡمُلۡکِ وَ لَمۡ یَکُنۡ لَّهٗ وَلِیٌّ مِّنَ الذُّلِّ وَ کَبِّرۡهُ تَکۡبِیۡرًا

(হে রাসুল! আপনি) বলুন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর; যিনি না কোনো সন্তান রাখেন, না তাঁর সার্বভৌমত্বে কোনো শরিক আছে এবং যিনি দুর্দশাগ্রস্ত হন না, যে কারণে তাঁর কোনো সাহয্যকারীর প্রয়োজন হতে পারে। সুতরাং আপনি স-সম্ভ্রমে তাঁর মাহাত্ম বর্ণনা করতে থাকুন।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ১১১)

সুরা কাহফ : আয়াত ১-৭৪

আসহাবে কাহাফের ঘটনা সমৃদ্ধ সুরা কাহফ মক্কায় নাজিল হয়েছে। সুরাটিতে ১১০ আয়াত এবং ১২টি রুকু রয়েছে। সুরাটি নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের সত্যতা প্রমাণের অনেক বড় দলিল হিসেবে সমাদৃত। এ সুরার ৯নং আয়াতের 'কাহফ' শব্দটি এসেছে।

সুরাটি জুমার দিনের বিশেষ আমল। এ সুরায় রয়েছে বিশেষ ৪টি শিক্ষণীয় ঘটনা। যা বিবেকবানদের জন্য উত্তম উপদেশ ও দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার উপয়। সুরা কাহফের বিশেষ ৪ উপদেশ ও দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার উপায়গুলো তুলে ধরা হলো 

১. আসহাবে কাহফের ঘটনা

কাহফ শব্দের অর্থ হলো গুহা। আর আসহাবে কাহফ মানে হলো গুহার অধিবাসী। গুহাবাসী একদল যুবকদের ঘটনার বর্ণনা রয়েছে এ সুরায়। এ যুবকদের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সুরাটি শুরু করা হয়েছে। এ যুবকরা এমন একটি জনপদে বসবাস করত যার অধিবাসী ও শাসকরা ছিল অবিশ্বাসী ও সীমালংঘনকারী। কাজেই যুবকেরা সেই নষ্ট সমাজের ভয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘এদের সাথে আর বসবাস নয়’। তারা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও আল্লাহর দ্বীনের প্রতি ভালোবাসা থেকে উজ্জিবীত হয়ে অত্যাচারী জনপদ থেকে হিজরত করলেন। কোরআনুল কারিমে এ ঘটনা এভাবে শুরু হয়েছে-

أَمْ حَسِبْتَ أَنَّ أَصْحَابَ الْكَهْفِ وَالرَّقِيمِ كَانُوا مِنْ آيَاتِنَا عَجَبًا

আপনি কি ধারণা করেন যে, গুহা ও গর্তের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর ছিল? (সুরা কাহফ : আয়াত ৯)

إِذْ أَوَى الْفِتْيَةُ إِلَى الْكَهْفِ فَقَالُوا

‘যখন যুবকরা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেয়; তখন (তারা এভাবে) দোয়া করে-

رَبَّنَا آتِنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً وَهَيِّئْ لَنَا مِنْ أَمْرِنَا رَشَدًا

উচ্চারণ : ‘রাব্বানা আতিনা মিল্লাদুংকা রাহমাতাও ওয়া হাইয়্যিলানা মিন আমরিনা রাশাদা।’

অর্থ : ‘হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে নিজের কাছ থেকে রহমত দান করুন এবং আমাদের জন্যে আমাদের কাজ সঠিকভাবে পূর্ণ করুন।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ১০)

فَضَرَبْنَا عَلَى آذَانِهِمْ فِي الْكَهْفِ سِنِينَ عَدَدًا

‘তখন আমি কয়েক বছরের জন্যে গুহায় তাদের কানের উপর ঘুমের পর্দা ফেলে দেই।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ১১)

ثُمَّ بَعَثْنَاهُمْ لِنَعْلَمَ أَيُّ الْحِزْبَيْنِ أَحْصَى لِمَا لَبِثُوا أَمَدًا

‘তারপর আমি তাদেরকে পুনরত্থিত করি, একথা জানার জন্যে যে, দুই দলের মধ্যে কোন দল তাদের অবস্থানকাল সম্পর্কে অধিক নির্ণয় করতে পারে।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ১২)

نَحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ نَبَأَهُم بِالْحَقِّ إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ آمَنُوا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنَاهُمْ هُدًى

আপনার কাছে তাদের ইতিবৃত্তান্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করছি। তারা ছিল কয়েকজন যুবক। তারা তাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। (সুরা কাহফ : আয়াত ১৩)

وَرَبَطْنَا عَلَى قُلُوبِهِمْ إِذْ قَامُوا فَقَالُوا رَبُّنَا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَن نَّدْعُوَ مِن دُونِهِ إِلَهًا لَقَدْ قُلْنَا إِذًا شَطَطًا

আমি তাদের মনোবল দৃঢ় করেছিলাম, যখন তারা উঠে দাঁড়িয়েছিল। তারপর তারা বলল- আমাদের পালনকর্তা আসমান ও জমিনের পালনকর্তা আমরা কখনও তার পরিবর্তে অন্য কোনো উপাস্যকে আহবান করব না। যদি করি, তবে তা অত্যন্ত গর্হিত কাজ হবে।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ১৪)

সুরাটির ৩১নং আয়াত পর্যন্ত আসহাবে কাহফের যুবকদের সুন্দর ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। যাতে মুমিন মুসলমানের ঈমানের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার রসদ রয়েছে। দাজ্জালের ফেতনা শুরু হলে কোরআনের এ শিক্ষায় নিজেকে আত্মরক্ষা করতে পারবে মুমিন।

শিক্ষা : ঈমানের উপর পরীক্ষা

এ থেকে বুঝা যায় যে, মহান আল্লাহর প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল অগাধ। ঈমানের পরীক্ষায় তারা আল্লাহর কাছে সফল হয়েছিলেন। আর আল্লাহ তাআলা তাদের গুহাতে আশ্রয় দিলেন এবং সূর্যালোক থেকে নিরাপদে রাখলেন। ফলে বহু বছর পর যখন তাদের ঘুম ভাঙ্গলো; তখন তাঁরা দেখলেন সেই অত্যাচারী জনপদের অবিশ্বাসী লোকেরা বিদায় নিয়েছে এবং ভালো লোকদের দ্বারা মন্দ লোকেরা প্রতিস্থাপিত হয়েছে।

২. দুইটি বাগানের মালিকের ঘটনা

আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমের এ সুরায় দ্বিতীয় একটি শিক্ষণীয় ঘটনা এভাবে তুলে ধরেছেন-

وَاضْرِبْ لَهُم مَّثَلًا رَّجُلَيْنِ جَعَلْنَا لِأَحَدِهِمَا جَنَّتَيْنِ مِنْ أَعْنَابٍ وَحَفَفْنَاهُمَا بِنَخْلٍ وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمَا زَرْعًا

‘আপনি তাদের কাছে দুই ব্যক্তির উদাহরণ বর্ণনা করুন। আমি তাদের একজনকে দুটি আঙ্গুরের বাগান দিয়েছি এবং এ দুইটিকে খেজুরে গাছ দ্বারা পরিবেষ্টিত করেছি এবং দুয়ের মাঝখানে করেছি শস্যক্ষেত্র।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৩২)

كِلْتَا الْجَنَّتَيْنِ آتَتْ أُكُلَهَا وَلَمْ تَظْلِمْ مِنْهُ شَيْئًا وَفَجَّرْنَا خِلَالَهُمَا نَهَرًا

‘উভয় বাগানই ফলদান করে এবং তা থেকে কিছুই হ্রাস করত না এবং উভয়ের ফাঁকে ফাঁকে আমি নদী প্রবাহিত করেছি।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৩৩)

وَكَانَ لَهُ ثَمَرٌ فَقَالَ لِصَاحِبِهِ وَهُوَ يُحَاوِرُهُ أَنَا أَكْثَرُ مِنكَ مَالًا وَأَعَزُّ نَفَرًا

‘সে ফল পেল। তারপর কথা প্রসঙ্গে সঙ্গীকে বলল- আমার ধন-সম্পদ তোমার চেয়ে বেশী এবং জনবলেও আমি অধিক শক্তিশালী।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৩৪)

وَدَخَلَ جَنَّتَهُ وَهُوَ ظَالِمٌ لِّنَفْسِهِ قَالَ مَا أَظُنُّ أَن تَبِيدَ هَذِهِ أَبَدًا

‘নিজের প্রতি জুলুম করে সে তার বাগানে প্রবেশ করল। সে বলল- আমার মনে হয় না যে, এ বাগান কখনও ধ্বংস হয়ে যাবে।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৩৫)

শিক্ষা : সম্পদের উপর পরীক্ষা

এভাবে এ সুরার ৩২-৪৬ আয়াত পর্যন্ত দুনিয়ার ধন-সম্পদ সম্পর্কে মহান আল্লাহ সুন্দর শিক্ষণীয় ঘটনা তুলে ধরেছেন। আল্লাহ দুইটি প্রাচুর্যময় সুন্দর বাগান দিয়ে ধন্য করেছিলেন, কিন্তু লোকটি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে ভুলে গেল; এমনকি পরকালের অস্তিত্ব সম্পর্কে আল্লাহর ওয়াদার উপর সন্দেহ পোষণ করল। কাজেই, এই অকৃতজ্ঞ লোকটির বাগানকে আল্লাহ তাআলা বিরান করে দিলেন। তারপর সে অনুতপ্ত হল, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে এবং তার এই অসময়ের অনুশোচনা তার কোনো উপকারে আসেনি।

দাজ্জাল ধন-সম্পদের প্রাচুর্য নিয়ে মানুষের সামনে উপস্থিত হবে। মানুষকে ধন-সম্পদের ফেতনায় ফেলবে। ফলে মানুষ সম্পদের লোভে পরে ঈমানহীন হয়ে যাবে। দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচতে এ ঘটনাও হবে ঈমানদার বান্দার জন্য আত্মরক্ষার অন্যতম উপায়।

৩. খিজির ও মুসা আলাইহি সালামের ঘটনা

যখন মুসা আলাইহি সালামের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘এই পৃথিবীতে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি কে?’ তিনি উত্তর করেছিলেন, ‘আমি’। কিন্তু আল্লাহ তাঁর কাছে উন্মোচন করে দিলেন যে, এমন এক ব্যক্তি আছেন; যাকে আল্লাহ তাঁর চেয়েও বেশি জ্ঞান দান করেছেন। সে ঘটনা এ সুরার ৬০নং আয়াত থেকে শুরু হয়েছে।

মুসা আলাইহি সালাম সেই ব্যক্তির সঙ্গে ভ্রমণ করলেন এবং দেখলেন, শিখলেন কিভাবে অনেক সময় আল্লাহ তাঁর অসীম জ্ঞানের কারণে এমন অনেক ঘটনা ঘটান যেগুলো আমাদের চোখে খারাপ বলে মনে হয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেগুলো মানুষের ভালোর জন্যই করা হয়। আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহিস সালামের এ ঘটনা এভাবে তুলে ধরেছেন-

فَوَجَدَا عَبْدًا مِّنْ عِبَادِنَا آتَيْنَاهُ رَحْمَةً مِنْ عِندِنَا وَعَلَّمْنَاهُ مِن لَّدُنَّا عِلْمًا

‘তারপর তাঁরা আমার বান্দাদের মধ্যে এমন একজনের সাক্ষাত পেলেন, যাকে আমি আমার পক্ষ থেকে রহমত দান করেছিলাম ও আমার পক্ষ থেকে দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৬৫)

শিক্ষা : জ্ঞানের উপর পরীক্ষা

হজরত মুসা আলাইহিস সালাম হজরত খিজির আলাইহিস সালামের সঙ্গে কিছু সময় অতিবাহিত করে বুঝলেন মহান আল্লাহর এমন অনেক বান্দা আছেন যাদের মহান আল্লাহ অনেক জ্ঞান দিয়েছেন। দাজ্জালও মানুষের সামনে সমৃদ্ধ অনেক জ্ঞানের কথা তুলে ধরে তার আধিপত্য বিস্তারে চেষ্টা করবে। এ ঘটনায় ঈমানদারদের জন্য রয়েছে দাজ্জালের ফেতনা থেকে মুক্তির উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা পাওয়ার উপায়।

৪. বাদশাহ যুলকারনাইনের ঘটনা

ক্ষমতাধর বাদশাহ যুলকারনাইন। তিনি সেই ক্ষমতাধর বাদশাহ; যাকে একই সঙ্গে জ্ঞান এবং ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল এবং তিনি সেই উভয় দানের শুকরিয়া আদায়ে সব সময় মানুষের উপকারে এবং কল্যাণে তা ব্যয় করতেন। তিনি জনপদের লোকদের ইয়াজুজ মাজুজ এর সমস্যার সমাধান করে দিয়েছিলেন আর নির্মাণ করেছিলেন একটি বিশাল প্রাচীর। আল্লাহ তাআলা এ ঘটনা এভাবে শুরু করেন-

وَيَسْأَلُونَكَ عَن ذِي الْقَرْنَيْنِ قُلْ سَأَتْلُو عَلَيْكُم مِّنْهُ ذِكْرًا

‘তারা আপনাকে যুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। (আপনি) বলুন, আমি তোমাদের কাছে তাঁর কিছু অবস্থা বর্ণনা করব।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৮৩)

إِنَّا مَكَّنَّا لَهُ فِي الْأَرْضِ وَآتَيْنَاهُ مِن كُلِّ شَيْءٍ سَبَبًا

‘আমি তাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের কার্যোপকরণ দান করেছিলাম।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৮৪)

এ সুরার ৯৮নং আয়াত পর্যন্ত বাদশাহ জুলকারনাইনের ঘটনার বর্ণনা স্থান পেয়েছে। যেখানে মানুষের কল্যাণে এবং ইয়াজুজ-মাজুজের ঘটনাও তাতে ওঠে এসেছে।

শিক্ষা : ক্ষমতার উপর পরীক্ষা

দাজ্জাল পৃথিবীতে এসে তার ক্ষমতা দেখাবে। ঈমানদার বান্দার জন্য তখন বাদশাহ যুলকারনাইনের ঘটনা হবে অনুপ্রেরণা। কোনো ক্ষমতার দম্ভ তাদের ঈমানহারা করতে পারবে। এ কারণেই জুমআর দিন মুমিন বান্দার ঈমান দৃঢ় করতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুরা কাহফ পড়ার উপদেশ দিয়েছেন। আর এভাবেই ঈমানদার বান্দা দাজ্জালের ফেতনা থেকেও মুক্তি পাবেন।

উল্লেখ্য এ ৪টি বিশেষ ঘটনা ছাড়াও কিছু বিশেষ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে সুরাটিতে। যাতে হজরত আদমকে সেজদা এবং ইবলিশের অস্বীকৃতির কথা। সুরাটির মাঝামাঝিতে আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন ইবলিসের কথা যে এই পরীক্ষাগুলোকে আরও কঠিন করে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ كَانَ مِنَ الْجِنِّ فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ أَفَتَتَّخِذُونَهُ وَذُرِّيَّتَهُ أَوْلِيَاء مِن دُونِي وَهُمْ لَكُمْ عَدُوٌّ بِئْسَ لِلظَّالِمِينَ بَدَلًا

‘যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, আদমকে সেজদা কর, তখন সবাই সেজদা করল ইবলিস ব্যতিত। সে ছিল জিনদের একজন। সে তার পালনকর্তার আদেশ অমান্য করল। অতএব তোমরা কি আমার পরিবর্তে তাকে এবং তার বংশধরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করছ? অথচ তারা তোমাদের শত্রু। এটা জালেমদের জন্যে খুবই নিকৃষ্ট বিনিময়।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৫০)

সুরাটির সঙ্গে দাজ্জালের সম্পর্ক

দাজ্জালের আবির্ভাব কেয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়ার অন্যতম বড় একটি লক্ষণ। দাজ্জালও ৪টি বিশেষ ফেতনা নিয়ে মানুষের সামনে উপস্থিত হবে। যে বিষয়গুলো সুরা কাহফে উল্লেখিত হয়েছে। আর তাহলো-

১. দাজ্জালের প্রতি ঈমান আনার আহ্বান

দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করেই মানুষকে আদেশ করবে, তারা যেন আল্লাহকে বাদ দিয়ে তার ইবাদত করে। তাকে প্রভু বলে মেনে নেয়। ঈমানের উপর এটি অনেক বড় পরীক্ষা। যা আসহাবে কাহফের সদস্যরা ঈমানের তাগিদে নিজ জনপদ ছেড়ে হিজরত করেছে। তারপরও ঈমান থেকে একটু সরেননি।

২. সম্পদের আধিপত্য দেখাবে

দাজ্জাল মানুষের সামনে সম্পদের আধিপত্য দেখাবে। মানুষকে সম্পদের ওপর পরীক্ষায় ফেলবে। সে মানুষকে সম্পদের লোভ দেখাবে। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে দুই বাগানের মালিকের ঘটনা তুলে ধরেছেন। যাতে দাজ্জালের সম্পদের লোভে মানুষ ঈমানহারা না হয়।

৩. দাজ্জাল মানুষকে জ্ঞানে ধাঁধায় ফেলবে

দাজ্জাল নিজেকে অনেক বড় জ্ঞানী হিসেবে মানুষের সামনে প্রকাশ করবে। এ কারণেই মহান আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা আলাইহিস সালাম ও হজরত খিজির আলাইহিস সালামের জ্ঞানের বিবরণ তুলে ধরেছেন। দাজ্জাল মানুষের সামনে অনেক সংবাদ প্রকাশ করবে। তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে ঈমানহারা না হতেই আল্লাহ তাআলা এ সুরায় জ্ঞানের বিষয়টি তুলে ধরেছেন।

৪. পৃথিবীর বিশাল নিয়ন্ত্রণ থাকবে দাজ্জালের হাতে

দাজ্জাল যখন আত্মপ্রকাশ করবে তখন পৃথিবীর এক বিশাল অংশ তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তার ক্ষমতা ছড়িয়ে পড়বে সবদিকে। আল্লাহ তাআলা বাদশাহ জুলকারনাইনের ক্ষমতার বিবরণ তুলে ধরেছেন। যাতে ঈমানদাররা ক্ষমতার কাছে নিজেদের ঈমান না হারিয়ে বসেন। এ কারণেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমিন মুসলমানকে অনুপ্রেরণা পেতে সুরা কাহফ পড়তে উৎসাহ দিয়েছেন।

৫. দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার উপায়

দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার উপায় রয়েছে সুরা কাহফে। সুরা কাহফ তেলাওয়াত করে এ মর্মার্থ ভালোভাবে উপলব্দি করে সে অনুযায়ী আমলেই দাজ্জালের ভয়াবহ ফেতনা থেকে মুক্ত থাকা যাবে। তাহলো-

> সৎ মানুষের সুসম্পর্ক রাখা

আল্লাহ তাআলা সুরা কাহফের ২৮নং আয়াতে দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচতে প্রথম উপায় হলো সৎ মানুষের সংস্পর্শে থাকা। এ কথার দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন এভাবে-

وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُم بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَن ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا

‘আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহবান করে এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি; যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার অনুগত্য করবেন না।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ২৮)

> দুনিয়ার জীবনের বাস্তবতা উপলব্ধি করা

দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার দ্বিতীয় উপায় হলো দুনিয়ার জীবনের বাস্তবতার বিষয়গুলো হৃদয় দিয়ে উপলব্দি করা। যাতে দুনিয়ার কোনো বাস্তবতায় মানুষকে ঈমানহারা করতে না পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَاضْرِبْ لَهُم مَّثَلَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاء أَنزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاء فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الْأَرْضِ فَأَصْبَحَ هَشِيمًا تَذْرُوهُ الرِّيَاحُ وَكَانَ اللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ مُّقْتَدِرًا

‘তাদের কাছে পার্থিব জীবনের উপমা বর্ণনা করুন। তা পানির ন্যায়, যা আমি আকাশ থেকে নাযিল করি। অতঃপর এর সংমিশ্রণে শ্যামল সবুজ ভূমিজ লতা-পাতা নির্গত হয়; অতঃপর তা এমন শুস্ক চুর্ণ-বিচুর ্ণ হয় যে, বাতাসে উড়ে যায়। আল্লাহ এ সবকিছুর উপর শক্তিমান।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৪৫)

> ধৈর্য্যশীল থাকা

দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার তৃতীয় উপায় হলো ধের্যশীল থাকা। কেননা কোরআনুল কারিমে হজরত মুসা আলাইহিস সালাম ও হজরত খিজির আলাইহিস সালামের জ্ঞানের এ ঘটনায় ধৈর্যের বিষয়টি ওঠে এসেছে। জ্ঞানী ব্যক্তিরা ধৈর্যের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করে থাকেন। এ ধৈর্যের শিক্ষায় মুমিন দুজ্জালের আক্রমণ থেকে মুক্তি পাবে। বিষয়টি বুঝতে পুরো ঘটনাটি পড়া আবশ্যক হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

قَالَ سَتَجِدُنِي إِن شَاء اللَّهُ صَابِرًا وَلَا أَعْصِي لَكَ أَمْرًا

‘মুসা বললেন, আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে ধৈর্য্যশীল পাবেন এবং আমি আপনার কোনো আদেশ অমান্য করব না।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ৬৯)

> বেশি বেশি সৎ কাজ করা

দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে দুনিয়ায় বেশি বেশি সৎ কাজ সম্পাদন করা। যা বাদশাহ জুলকারনাইন করেছেন। অত্যাচারী ইয়াজুজ-মাজুজের নির্যাতন থেকে জনপদের মানুষকে নিরাপত্তা দান করতে তিনি তৈরি করেছিলেন বিশাল প্রাচীর। আল্লাহ তাআলা বলেন-

قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَمَن كَانَ يَرْجُو لِقَاء رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا

‘বলুন, আমি ও তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহই একমাত্র ইলাহ। অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন, সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার এবাদতে কাউকে শরীক না করে।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ১১০)

> আল্লাহর দিকে আহ্বান

দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার পঞ্চম উপায় হলো মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা। সুরা কাহফের শুরু দিকে মহান আল্লাহ এমনটি ইঙ্গিত দিয়েছেন এভাবে-

وَاتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِن كِتَابِ رَبِّكَ لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ وَلَن تَجِدَ مِن دُونِهِ مُلْتَحَدًا

‘আপনার প্রতি আপনার পালনকর্তার যে, কিতাব নাজিল হয়েছে, তা পাঠ করুন। তাঁর বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নাই। তাঁকে ব্যতিত আপনি কখনই কোনো আশ্রয় স্থল পাবেন না।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ২৭)

> পরকালের কথা স্মরণ করা

দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচতে পরকালের কথা বেশি স্মরণ করে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা। আর তাতে এ ভয়াবহ ফেতনা থেকে মুক্তি পাবেন মুমিন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَيَوْمَ نُسَيِّرُ الْجِبَالَ وَتَرَى الْأَرْضَ بَارِزَةً وَحَشَرْنَاهُمْ فَلَمْ نُغَادِرْ مِنْهُمْ أَحَدًا - وَعُرِضُوا عَلَى رَبِّكَ صَفًّا لَّقَدْ جِئْتُمُونَا كَمَا خَلَقْنَاكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ بَلْ زَعَمْتُمْ أَلَّن نَّجْعَلَ لَكُم مَّوْعِدًا - وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً إِلَّا أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا

‘যেদিন আমি পর্বতসমূহকে পরিচালনা করব এবং আপনি পৃথিবীকে দেখবেন একটি উম্মুক্ত প্রান্তর এবং আমি মানুষকে একত্রিত করব অতঃপর তাদের কাউকে ছাড়ব না। তারা আপনার পালনকর্তার সামনে পেশ হবে সারিবদ্ধ ভাবে এবং বলা হবেঃ তোমরা আমার কাছে এসে গেছ; যেমন তোমাদেরকে প্রথম বার সৃষ্টি করেছিলাম। না, তোমরা তো বলতে যে, আমি তোমাদের জন্যে কোন প্রতিশ্রুত সময় নির্দিষ্ট করব না। আর আমলনামা সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে; তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে ভীত- সন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবে- হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা। এ যে ছোট বড় কোন কিছুই বাদ দেয়নি-সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারও প্রতি জুলুম করবেন না। (সুরা কাহাফ, আয়াত ৪৭-৪৯)

সুরা কাহফ অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি আমলি সুরা। সুন্নাতের অনুসরণে এ সুরার তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন মুমিন মুসলমানকে দাজ্জালের ভয়াবহ ফেতনা থেকে মুক্ত করবে।

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, সুরা কাহফ তেলাওয়াত করা। কেননা হাদিসের একাধিক বর্ণনা প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

> ‘যে ব্যক্তি সুরা কাহফের প্রথম ১০ আয়াত মুখস্ত করে, তাকে দাজ্জালের ফেতনা থেকে রক্ষা করা হয়’ (মুসনাদে আহমদ)

> ‘যে ব্যক্তি সুরা কাহফের প্রথম ১০ আয়াত মুখস্ত করবে, সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকবে।’ (মুসলিম)

দাজ্জালের ফেতনা থেকে মুক্তির দোয়া

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে কোরআন মাজিদের সুরা শেখাতেন ঠিক তেমনিভাবে দাজ্জালের ফেতনা থেকে বাঁচার জন্য এ দোয়াটিও শেখাতেন। তাহলো-

اَللَّهُمَّ اِنِّي اَعُوْذُبِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيْح الدَّجَّال

উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আ’উজুবিকা মিন ফিতনাতি মাসিহুদ দাজ্জাল।’ (বুখারি)

অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে অভিশপ্ত দাজ্জালের ফেতনা থেকে আশ্রয় চাই।’

এছাড়াও সুরাটিতে আসহাবে কাহাফের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করা যুবকরা আল্লাহর কাছে এভাবে সাহায্য কামনা করেছে-

رَبَّنَا آتِنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً وَهَيِّئْ لَنَا مِنْ أَمْرِنَا رَشَدًا

উচ্চারণ : 'রাব্বানা আতিনা মিল্লাদুংকা রাহমাতাও ওয়া হাইয়িই লানা মিন আমরিনা রাশাদা'

অর্থ : 'হে আমাদের পালনকর্তা! নিজের কাছ থেকে আমাদের রহমত দান করুন এবং আমাদের জন্যে আমাদের কাজ সঠিকভাবে পূর্ণ করুন।' (সুরা কাহফ : আয়াত ১০)

আল্লাহর স্মরণ ছাড়া কোনো কাজ আগামীকাল বা ভবিষ্যতে করার কথা বলা ঠিক নয়। এসব ক্ষেত্রে কোনো কিছু ভুলে গেলে এ আয়াত তেলাওয়াত করা যেতে পারে। তবে আল্লাহ সঠিক পথ দান করবেন। এ বিষয়ে কোরআনে এসেছে-

'আপনি কোনো কাজের বিষয়ে বলবেন না যে, সেটি আমি আগামীকাল করব।`আল্লাহ ইচ্ছা করলে' বলা ব্যতিরেকে। যখন ভুলে যান, তখন (পড়ুন)-

وَاذْكُر رَّبَّكَ إِذَا نَسِيتَ وَقُلْ عَسَى أَن يَهْدِيَنِ رَبِّي لِأَقْرَبَ مِنْ هَذَا رَشَدًا

'আপনার পালনকর্তাকে স্মরণ করুন এবং বলুন, আশা করি আমার পালনকর্তা আমাকে এর চেয়েও কাছাকাছি সত্যের পথ নির্দেশ করবেন।' (সুরা কাহফ : আয়াত ২৪)

মুমিন মুসলমান নিজেদের ভুল ও গাফলতির অন্যায় থেকে মুক্ত থাকতে কোরআনের এ ভাষা ব্যবহার করে আল্লাহর কাছে এ আবেদন করতে পারেন নিঃসন্দেহে-

لَا تُؤَاخِذْنِي بِمَا نَسِيتُ وَلَا تُرْهِقْنِي مِنْ أَمْرِي عُسْرًا

উচ্চারণ : লা তুআখিজনি বিমা নাসিতু ওয়া লা তুরহাক্বনি মিন আমরি উসরা'

অর্থ : 'আমাকে আমার ভুলের জন্যে অপরাধী করবেন না এবং আমার কাজে আমার উপর কঠোরতা আরোপ করবেন না।' (সুরা কাহফ : আয়াত ৭৩)

এমনকি মক্কার মুশরিকরাও নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য আহলে কিতাবের অনুসারীরা তাঁর সামনে তিনটি প্রশ্ন করেছিল। সে প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ তাআলা সুরা কাহাফ নাজিল করেছেন।

প্রশ্ন তিনটি হলো-

১. আসহাবে কাহাফ কারা ছিল?

২. হজরত খিজিরের ঘটনা ও তাৎপর্য কি কি? হাদিসের বর্ণনা মতে দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল রূহ সম্পর্কে।

৩. জুলকারনাইনের ঘটনাটি কি?

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুরা কাহাফের মাধ্যমে বনি ইসরাইলদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। আর তাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ের সত্যতা প্রকাশ পেয়েছিল। এভাবেই আল্লাহ তাআলা ইসলামকে বিজয়ী করেছেন।

আজকের ১২ তারাবির শেষ আয়াতে মুসা আলাইহিস সালামের সামনে একজন নিষ্পাপ ছোট্ট বালককে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটে। আর তা ছিল এমন-

فَانۡطَلَقَا ٝ حَتّٰۤی اِذَا لَقِیَا غُلٰمًا فَقَتَلَهٗ ۙ قَالَ اَقَتَلۡتَ نَفۡسًا زَکِیَّۃًۢ بِغَیۡرِ نَفۡسٍ ؕ لَقَدۡ جِئۡتَ شَیۡئًا نُّکۡرًا

'অতপর তারা চলতে লাগল। অবশেষে যখন একটি বালকের সাক্ষাত পেলেন, তখন তিনি তাকে হত্যা করলেন। মূসা বললেন, আপনি কি একটি নিস্পাপ জীবন শেষ করে দিলেন প্রাণের বিনিময় ছাড়াই? নিশ্চয়ই আপনি তো এক গুরুতর অন্যায় কাজ করলেন।' (সুরা কাহফ : আয়াত ৭৪)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআনের এ গুরুত্বপূর্ণ সুরা দুটি বুঝে পড়ার এবং তাওহিদ রেসালাত ও পরকালের ওপর গভীর বিশ্বাস রেখে নিজেদের আকিদা-বিশ্বাসকে শিরকমুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন। কোরআনি জিন্দেগি যাপন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।