গোপালগঞ্জে ভাসমান কৃষির আধুনিক প্রযুক্তিতে খাদ্য নিরাপত্তার সম্ভাবনা

নিউজ ডেস্ক

সময় একাত্তর

প্রকাশিত : ১১:০৯ এএম, ২৩ অক্টোবর ২০২২ রোববার

গোপালগঞ্জে ভাসমান কৃষির আধুনিক প্রযুক্তিতে খাদ্য নিরাপত্তার সম্ভাবনা

গোপালগঞ্জে ভাসমান কৃষির আধুনিক প্রযুক্তিতে খাদ্য নিরাপত্তার সম্ভাবনা

গোপালগঞ্জ জেলায় কচুরিপানার ভাসমান বেডে কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এখন ভাসমান বেডে সারা বছর বাণিজ্যিক ভাবে  সবজি, ফল, শাক ও মসলা উৎপাদিত হচ্ছে। এসব সবজি, ফল ও মসলা বিক্রি করে কৃষক লাভবান হচ্ছেন।  গোপালগঞ্জ জেলার ৫ উপজেলার ১ হাজার ৮ ০০ কৃষক লাভজনক এ প্রযুক্তি গ্রহণ করেছেন। গোপালগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. অরবিন্দ কুমার রায় এ তথ্য জানিয়েছেন। 
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, সনাতন পদ্ধতিতে শত বছর ধরে গোপালগঞ্জে  কচুরিপানার ভাসমান বেডে সবজি উৎপাদিত হয়ে আসছে। টুঙ্গিপাড়া উপজেলার জলমগ্ন মিত্রডাঙ্গাসহ আশপাশের গ্রামের কৃষক নিজের প্রয়োজনে এ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। বেডের সাইজ তারা বড় করত। তাই ¯্রেেত ও বাতাসে বেড ভেঙ্গে যেত। এ চাষাবাদে তাদের সমস্যার অন্ত ছিলণ না। তখন তারা এ বেডে ঢ্যাড়শ, লাল শাক, ডাটাসহ পাতা জাতীয় সবজির আবাদ করত। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে  ভাসমান কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ করে ৫ বছরে আগে ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা সম্প্রসারণ এবং  জনপ্রিয় করণ প্রকল্প গ্রহণ করে। পরে তারা মাঠ পর্যায়ে সরেজমিনে কৃষকদের সাথে  গবেষণা কাজ শুরু করে। তারা বেডের আকার ছোট করেন। ভাসমান বেডে পাতা, লতা , ফল ও মসলা জাতীয় ফসলের চাষাবাদ শুরু করেন। এতে গোপালগঞ্জে ব্যাপক সাফল্য এসেছে। আর এ সাফল্যই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা সম্প্রসারণ এবং  জনপ্রিয় করণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান তালুকদার বলেন, আমাদের কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। দিনদিন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে জলবায়ূ পবিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশংকা রয়েছে। এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জলমগ্ন এলাকার জমি বর্ষাকালে সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার এ প্রকল্প গ্রহণ করে। গত ৫ বছর ধরে আমরা ভাসমান কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছি। এ প্রযুক্তিতে খাদ্য উৎপাদন করে পুষ্টি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। সেই সাথে খাদ্য মানুষের হাতের নাগালে থাকছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্প্রসারণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার মিত্রডাঙ্গা গ্রামে ভাসমান কৃষির আধুনিক প্রযুক্তির চাষাবাদ পরিদর্শন করেছেন। এছাড়া তিনি কৃষক, গবেষক ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছেন। এটি তিনি দেশের নীতি নির্ধারকদের কাছে উপস্থাপন করবেন। তারপর নীতি নির্ধারকরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। ভাসমান কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারিত হলে দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষের পুষ্টি নিশ্চিত সম্ভব হবে। 
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের  গোপালগঞ্জ সরেজমিন গবেষণা  বিভাগের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মহসীন হাওলাদার ও এইচ.এম খায়রুল বাসার বলেন, গোপালগঞ্জের অধিকাংশ জমি বছরের ৮ মাস জলমগ্ন থাকে। বছরে এসব জমিতে একটি মাত্র ফসল বোরোধান উৎপাদিত হত। তাই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য  জলজ জঞ্জাল কচুরিপানাকে কাজে লাগিয়ে কৃষক পানির ওপর ভাসমান বেড তৈরী করেন। সেখানে চাষাবাদ করে পাতা জাতীয় সবজি উৎপাদন করতেন। এতে তারা পারিবারিক প্রায়োজন মেটাতে পারতেন। আমরা ভাসমান বেডে কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি কৃষককে শিখিয়ে দিয়েছি। এখন তারা এখানে তরমুজ, বাঙ্গি, পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, হলুদ, শসা, লাউ, কুমড়া, টমেটো, ঢ্যাড়শ, চিচিঙ্গা, ফুলকপি, ঝিঙ্গে, বাঁধাকপি, ব্রোকলি, লাল শাক, ঘি-কাঞ্চন শাক, পালংশাক সহ বিভিন্ন ফসল বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করছেন। এগুলো নিজেরা খাচ্ছেন। বাড়তি ফসল বাজারে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করছেন। এ পদ্ধতির চাষাবাদ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
মিত্রডাঙ্গা গ্রামের কৃষক শক্তি পদ কীর্ত্তনীয়া (৬৫) বলেন, আমরা ১৫/২০ জন কৃষক সারা বছর ভাসমান বেডে আধুনিক প্রযুক্তিতে  চাষাবাদ করি।  যে ফসল উৎপাদিত হয় তা বাজারে বিক্রি করে প্রচুর টাকা আয় করতে পারি। আমাদের দেখাদেখি অনেকেই সারবছর ভাসমান বেডে চাষাবাদে ঝুঁকছেন। এ পদ্ধতির চাষাবাদে বিষমুক্ত নিরাপদ ফসল উৎপাদন করা হয়। তাই বাজারে আমাদের উৎপাদিত ফসলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। 
মিত্রডাঙ্গা গ্রামের কৃষাণী চম্পা কীর্ত্তনীয়া (৫০) বলেন, আগে আমারা বাপ-দাদার দেখানো পদ্ধতিতে ভাসমান বেডে   চাষাবাদ করতাম। সেখানে ফসল তেমন ভালো হত না। আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করার পর ফসল ভালো হচ্ছে। আমরা এখন ভালো আছি। 
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্প্রসারণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া বলেন, গোপালগঞ্জে ২২৯ টি বিল ও জলাভূমি রয়েছে। বর্ষাকালে এগুলো জলমগ্ন হয়ে পড়ে। এখানে প্রচুর কচুরিপানা পাওয়া যায়। তাই কচুরিপানা দিয়ে পানির ওপর ভাসমান বেড তৈরী করে ২২৯ টি বিল ও জলাশয়ে  চাষাবাদ সম্প্রসারণ করতে পারলে এ জেলা থেকে উৎপাদিত ভাসমান বেডের সবজি দেশের বিশাল একটি অংশের সবজির চাহিদা মেটাতে পারবে। তিনি আরো বলেন, এ পদ্ধতির চাষাবাদে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কচুরি দিয়ে বেড তৈরীর অধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। এখানে এ চাষাবাদে ওইসব আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করার সুপারিশ করা হবে। আমি ভাসমান বেডে চাষাবাদ এলাকা পরিদর্শন করেছি। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছি। এটি আমি নীতি নির্ধারকদের কাছে উপস্থাপন করব। তারা এ চাষাবাদের ভবিষ্যত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে এ পদ্ধতির চাষাবাদ ভুমিকা রাখবে।