ছোটগল্প: সোনার পাথরবাটি (৩য় পর্ব)

অনলাইন ডেস্ক

সময় একাত্তর

প্রকাশিত : ০২:৪৪ পিএম, ২৬ অক্টোবর ২০২২ বুধবার

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

: না আসুক! ওই যে রবী ঠাকুর লিখেছেন, ‘নিজের সে বিশ্বের সে বিশ্ব দেবতার/ সন্তান নহে গো মাতা সম্পত্তি তোমার…।’ কি জানি লাইন দু’খানা ঠিকঠাক বলতে পারলাম কি না!


: না পারলি ঠিকঠাক! তুই তো আমার চোখ খুলে দিয়েছিস। আমি সব এক জায়গায় বেঁধে রেখে প্রতিদিন চুলোচুলিতে ভুগছি! দুই ছেলেই উদগ্রীব কাকে কি দেয়া হবে। মেয়েও কম যায় না। আসলে তোর মতো স্বপ্ন দেখিয়ে তো বড় করিনি। নিজেও তো কোনো স্বপ্ন দেখলাম না। ছেলেমেয়েদের খালি আঁচলে বেঁধে রেখে বড় করেছি!

: সে জন্যই তো দুঃখ করতে করতে থেমে যাই! যা অনেকে পারে না, আমার ছেলেরা সেরকম একটি জায়গা নিজের নিজের জন্য করে নিয়েছে। আর কি মনে হয় জানিস, পৃথিবীটা এখন হাতের মুঠোয়। তোমার বন্ধু সাদিয়াকে দেখো, মা একা বাসায়, ছেলে পাশের আরেক ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে।

: তাই নাকি? আমাকে বলেনি তো!
: বড় ছেলে বিদেশ থেকে ফিরে এসে মায়ের কাছেই উঠেছিল। কিছুদিন যেতেই বউ মুখ ভার করে থাকত। শেষে সাদিয়া বলল, সাদিয়াই নাকি ছেলেকে বুঝিয়ে বলেছে, এমনিতে বৌমার পেটে বাচ্চা থাকছে না। উচ্চশিক্ষা শেষে বাচ্চা নিতে মেয়েদের যা সমস্যা তার সবই প্রকট মেয়েটির ভেতর। তাই সাদিয়া ছেলেকে বলেছে, ও যা চায়, তাই করো। তোমরা আলাদা বাসা নিয়ে থাকো। আমার কথা ভেবো না। আমি বেশ আছি। তোমার বাবা মারা যাওয়ার পর তোমাদেরকে যেটুকু বড় করে দিতে পারছি, সেটুকুই আমার শান্তনা!’
: সাদিয়ার মতো ঘটনা ভুরি ভুরি! তুই তোর কথা বল্, পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দিয়ে পেলি কাউকে?

: অসংখ্য পাই! তবে যাকে আমার পছন্দ, আমাকে তার পছন্দ না! আর বেশির ভাগের সমস্যা আমি অমন তিন ছেলের মা! শেষে তারা কোন লাঠালাঠিতে পড়ে!
: আসলে এসব ক্ষেত্রে প্রার্থী তো সব ঘরপোড়া গরু! তাই তারা ঝালিয়ে জানতে চায়। আচ্ছা আমি বলি কি, শোন, তুই বিয়েটিয়ে করে নতুন ঝঞ্জাট না বাঁধিয়ে বরং লিভ টুগেদার কর!
: সুরমা আপা, তুই বলিস্ কি? শোন্, হাজবেণ্ড মারা যাওয়ার পর থেকে আমার সেই কাঁচা বেদনার ভেতরই তোর মতো এইরকম পরামর্শ দেখি অনেকে আমাকে সেধে সেধে কানে গুজে দিয়েছে। কারণ কি রে? আমি কি আল্ট্রা মডার্ণ?
: সেটাই নির্ঝঞ্জাট যে! কেউ জানলো না…।
: শোন, সুরমা আপা, একটা কথা কখনো ভেবে দেখেছিস?
: কি?
: কলমা পড়ে একটি সম্পর্কের পরে তারা যা-ই করুক, পুরুষমানুষ কখনো কোথাও কারো কাছে গিয়ে বলে না, যে আজ বউয়ের সাথে এই এই করলাম। তাছাড়া, যতই ভাল মানুষ হোন, যতই তিনি পার্সোনালিটিসম্পন্ন, ইনটেলেকচ্যুয়াল হোন, তিনি কোথাও না কোথাও তার অবৈধ সম্পর্কের কথা উগরে দেন!
: কারণ কি?
: পরের বৌকে করার ভেতর পৌরুষ নিহিত আছে কি না…। হয়তো কিছুই করার মুরদ নেই। হয়ত শুধুই দরজা বন্ধ করা পর্যন্তই সার ছিল। তবুও।
: যাহ্!
: যাহ্, কি রে? বাজারে যে এত এত মানুষ সম্পর্কে যত রটনা, তোর মনে হয় সুরমা আপা, কেউ বেড়া ভেঙে দেখতে গিয়েছিল, ওইসব ঘটনা ঘটানোর সময়? কে কাকে সাথে নিয়ে বিদেশে গিয়ে কোন হোটেলে কি করেছে, তা এদেশের কেউ দেখে এসেছিলো?
: তাহলে রটে কি করে?
: সব নিজেরা রটায়! মানে পুরুষটিই রটায়! শোন্, সুরমা আপা, আমি ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে এই বুঝেছি, প্রয়োজনে যারা বিয়ে করে, তাদের যে বদনাম রটে, তা কিন্তু বিয়ে করা নিয়ে নয়!
: তাহলে?
: যদি মানুষটি যদি একজন আরেকজনের জন্য মানানসই হয়, তা নিয়ে আর বেশি কথা ওঠে না। আর এখানে একটি অধিকারবোধেরও তো বিষয় আছে। কোন জোরে তুই আস্ত একটি মানুষকে কোনো দায়বদ্ধতা ছাড়া অধিকার করে রাখতে চাইবি?
: তাই তো! আমাদের তো সমাজ নামের ক্ষুদ্র একটি গণ্ডির ভেতর বসবাস করতে হয়! এমন কিছু করা উচিৎ নয়, যে গর্তে গিয়ে লুকিয়ে বাঁচতে হয়।
: সমাজকে তোয়ক্কা না করলে সেটা অন্যকথা। একজনের সাথে বনিবনা হলো না, আবার আরেকটাকে জুটিয়ে নিলাম! আর একবার এই খেলায় নামলে কেউ আর ফেরে না!
: সেটাও যারা পারে, তাদেরও আমি দোষ দিচ্ছি না। তাদেরও তুড়ি মেরে চলার যোগ্যতা থাকে। কিন্তু তুই তো ওই সমাজের না!
: বাহ, তোর দেখি অন্তর্দৃষ্টি খুলে গেছে! আমি তোর এতোটা ধার এত তাড়াতাড়ি আশা করিনি!
: আরে আমার তো তোর মায়ের বন্ধু হওয়া উচিৎ ছিলো। তাই আমি একটু সেকেলে না? ভাগ্যিস তোর কর্তা আমার কর্তা দুই ভাইয়ের মতো ছিল। তবু কিন্তু আমরা জা হইনি! এখন খুলে বল, তুই কি চাস্?
: তুই তো আমার বোনও হতে চাইলি না! শোন্, আমি চাই, আমার নিজের বয়সের থেকে কম তো নই-ই। আবার বেশিও না! কারণ আমি এখন দুনিয়াটা ঘুরে কাটাতে চাই। বুড়ো বিয়ে করে তার সেবা করে মরবো নাকি? আজ বাত, কাল দাঁতে ব্যথা। বসে বসে নুনের পোটলা গরম করে সেক দাও…!
সুরমা হাসতে হাসতে গড়িয়ে বলে, যদি অতো টাকাওয়ালা কাউকে না পাস্?
: আরে অন্যের গোয়ালে তাজা গরু দেখে আমি দড়ি পাকাই না! আমার নিজের তো আর দায় দায়িত্ব নেই। আমারটুকু নিয়ে আমার এখন হিসেব।
: দেখ, তোর এই আশা যেন পূর্ণ হয়!
: তাই বলে ভাবিস না ছোটভাই বা দেবরের মতো কাউকে বগলদাবা করে ঘুরতে চাই। কারণ আমার ছেলেরা বাবা ডাকবে না ঠিকই, কিন্তু আঙ্কেল যেন ডাকতে পারে। নিজেকে আমার লুকিয়ে রাখতে হয়, তেমন কোনো কাজই আমি কখনো করবো না, সুরমা আপা!
: কিন্তু পাচ্ছিস না তো!
: ওই যে বললাম, যাদেরকে পছন্দ হয়, তাদের হয়তো সব মিলানো হিসেব থেকে আমি ছুটে যাই!
: আমার তো অতো বুদ্ধিসুদ্ধি নেই রে! জীবন থেকে তুই অনেক শিক্ষা নিয়েছিস। যে শিক্ষা নেয়ার ধাৎ আমার নেই। তবু আজ মাথায় করে কিছু নিয়ে গেলাম! খালি তো সংসার নামক চরকিতে খুরপাক খেয়ে জীবন গেল। চাকরি করতে ঢুকে দেখি যাদের জন্য চাকরি করবো, তারা বখে যায়। শেষে ষোলআনাই গিন্নী…।
এই যে একটি মানুষের চলে যাওয়ার পর তার অভাব কত প্রকটভাবে বুঝতে পারছিস্। অথচ ভালবেসেই আমি বিয়ে করেছিলাম…।
: শোন্, শোন, খুব গোপনে একটি কথা বলি আপা, অভাব প্রকটভাবে বুজছি মানে, নেবুলা দেয়ালের ছবির দিকে আঙুল তুলে বললো, মাঝে মাঝে আমার মনে হয় উনি নিজে মরে বেঁচেছেন অথবা আমাকে বাঁচিয়েছেন! খুব সূক্ষ্ম সূ্ক্ষ্ম আচরণ ব্যাখ্যা করে বুঝতে পারতাম, উনি যে সাধারণ পরিবার থেকে একটি কম বয়সী মেয়েকে ধরে এনেছিলেন, তার সে জায়গা থেকে মেয়েটি যে বহুদূরে সরে গেছে, এগিয়ে গেছে, ওনার বেয়াড়া সন্তানের মা হয়ে ওঠার প্রানান্ত চেষ্টা করেছে, তার একটিও উনি মূল্যায়ণ করতে পারতেন বলে আমার মনে হয় না!
মাঝে মাঝে ওনার আচরণে আমার কাছে তাই মনে হতো! একাকী কষ্টে গুমরে মরেছি।
: ঠিক এই কথাটিই আমি বলতে চাচ্ছি। আমারও এখন আমাদের সম্পর্কটা বিষের মতো ঠেকে! কেউ কারো সাথে ভাল করে দুটো কথা বলি না। আর এই ভাল করে কথা না বলাটাই দু’জনের অভ্যেস হয়ে গেছে। এখন নাদিমকে আমার কাঁটার মতো লাগে। কারণ পরোক্ষভাবে সব সময় আমাকে ইনসাল্ট করেই চলে…! আমি যে টানাপোড়েনের সংসারটিতে সারাক্ষণ খেটে মরি, আমার জন্য তার কোনো দরদই নেই। প্রতিদিন আমার ছেলেমেয়ের সামনে আমার সম্মান ক্ষয় করে চলছে।

(চলবে)