সুন্দরবনের বাঘ গণনায় ক্যামেরা ট্র্যাপিং শুরু

নিউজ ডেস্ক

সময় একাত্তর

প্রকাশিত : ১০:২৯ এএম, ২ জানুয়ারি ২০২৩ সোমবার

সুন্দরবনের বাঘ গণনায় ক্যামেরা ট্র্যাপিং শুরু

সুন্দরবনের বাঘ গণনায় ক্যামেরা ট্র্যাপিং শুরু

সুন্দরবনের বাঘ (রয়েল বেঙ্গল টাইগার) গণনায় ক্যামেরা ট্র্যাপিং শুরু হয়েছে। তৃতীয়বারের মতো বাঘ গণনায় এ ক্যামেরা ট্র্যাপিং নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়েছে। ১ জানুয়ারি বিকালে সুন্দরবনের কালাবগি এলাকায় বাঘ জরিপ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার উদ্বোধন করেন।

বাঘ জরিপ তৃতীয় হলেও এবারই প্রথম বাঘের পাশাপাশি হরিণ ও শূকর গণনা করার উদ্দোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্যই সুন্দরবনের ৬৬৫ গ্রিড জরিপের আওতায় নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। প্রতিটি গ্রিডে জোড়া ক্যামেরা বসানো হবে। যা ৪০ দিন থাকবে। প্রতি ১৫ দিন অন্তর ক্যামেরার ব্যাটারি ও এসডি কার্ড পরিবর্তন করতে হবে। বাঘ গণনার ফল জানা যাবে ২০২৪ সালের জুন-জুলাইয়ে। এবারই সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জ এলাকা জরিপের আওতায় আসছে। এর মধ্যে আগামী মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত খুলনা এবং সাতক্ষীরা রেঞ্জে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের কাজ চলবে। আর নভেম্বর-ডিসেম্বরে চাঁদপাই এবং শরণখোলা রেঞ্জে কাজ করা হবে। ফলে এ জরিপ কাজ বছর জুড়েই করা হবে।৩১ ডিসেম্বর খুলনা ফরেস্ট ঘাটে ক্যামেরা ট্র্যাপিং বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। প্রশিক্ষণে প্রধান অতিথি ছিলেন খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার। সভাপতিত্ব করেন সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প পরিচালক ও সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল, সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন।

সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প পরিচালক ও সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর “সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প”-এর আওতায় বাঘ জরিপের অংশ হিসেবে খাল সার্ভে করার কাজ শুরু হয়। এর আওতায় সাতক্ষীরা রেঞ্জে বনের মধ্যে বাঘের গতিবিধি ও পায়ের ছাপ লক্ষ করার কাজ করা হয়েছে। ১ জানুয়ারি থেকে তৃতীয়বারের মতো ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ জরিপ শুরু হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে ২০১৫ এবং ২০১৮ সালে ক্যামেরার মাধ্যমে বাঘ জরিপ করা হয়েছিল। প্রথম দুইবার খুলনা, সাতক্ষীরা এবং শরণখোলা রেঞ্জ জরিপ এলাকার আওতাভুক্ত ছিল। এবার চাঁদপাই রেঞ্জও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জই ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের আওতায় থাকছে।

‘সুন্দরবন অনেক বড় এলাকা। এক বছরের মধ্যে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে এই কাজ করা হবে। ৪৫০টি ক্যামেরা রয়েছে, সেগুলো দিয়ে মার্চের মধ্যে জরিপ কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। শুষ্ক মৌসুমে ক্যামেরাগুলো বসাতে হয়। বর্ষা মৌসুমে এই কাজ করা কঠিন। তাই আগামী মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত খুলনা এবং সাতক্ষীরা রেঞ্জে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের কাজ চলবে। আর নভেম্বর-ডিসেম্বরে চাঁদপাই রেঞ্জ এবং শরণখোলা রেঞ্জে কাজ করা হবে।’

তিনি জানান, ৪টি রেঞ্জের ৬৬৫টি গ্রিডে জোড়া ক্যামেরা বসানো হবে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা রেঞ্জে ২০০টি, খুলনা রেঞ্জে ১৪০টি, শরণখোলা রেঞ্জে ১৮০টি, চাঁদপাই রেঞ্জে ১৪৫টি। প্রতিটি গ্রিডে একজোড়া ক্যামেরা বসানো হবে। প্রতি গ্রিডে ৪০ দিন ক্যামেরা থাকবে। প্রতি ১৫ দিন অন্তর ক্যামেরার ব্যাটারি ও এসডি কার্ড পরিবর্তন করতে হবে।

বাঘের সংখ্যা নির্ণয় প্রসঙ্গে ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে আমরা ছবি তুলবো। তারপর অ্যানালাইসিস করবো। এরপরই বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হবে। ফলে ২০২৪ সালের জুন-জুলাই মাসে গিয়ে বাঘের সংখ্যা ঘোষণা করা সম্ভব হবে।এই প্রকল্পের মাধ্যমে হরিণ, শূকরের সংখ্যাও নির্ণয় করার চেষ্টা করবো।’

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাঘের হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ ও সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণের জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় গত বছরের ২৩ মার্চ ‘সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এর মধ্যে শুধু বাঘ শুমারি খাতে ব্যয় ধরা হয় ৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। প্রকল্পটির মেয়াদ গত বছরের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। ২০২২ সালের অক্টোবর মাস থেকে বাঘ গণনার কাজ শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের অর্থ ছাড় নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। পরে অক্টোবরে ৩ কোটি ২১ লাখ টাকা ছাড় দেয় পরিকল্পনা কমিশন। এরপরই বাঘ জরিপের কাজ গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে। প্রথমে খাল সার্ভে করা হয়। আর এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ শুমারির কাজ শুরু হলো।

সুন্দরবন বিভাগ সূত্রে আরও জানা গেছে, সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব নিরসন করতে পারলে বাঘ সংরক্ষণ করা সহজ হবে। সুন্দরবনের বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেন্সপন্স টিমের ৩৪০ জন সদস্য রয়েছেন। ভিলেজ টাইগার রেন্সপন্স টিম, কমিউনিটি পেট্রোল গ্রুপ এবং ভিলেজ কনজারভেশন ফোরামের সবাইকে নিয়ে সচেতনতামূলক কাজ চলছে। বাঘ যখন গ্রামে চলে আসে, সেই সময়ে বাঘকে কীভাবে নিরাপদে সুন্দরবনে ফিরিয়ে নেওয়া যায় সেই ব্যাপারে কাজ করা হবে। এ ছাড়া সুন্দরবনের ধানসাগরসহ বিভিন্ন এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে আগুন লাগে। ওই এলাকা বাঘের আবাসস্থল। ওই আগুন নির্বাপণের জন্য সেখানে কিছু টাওয়ার স্থাপন করা হবে। সেজন্য ফায়ার ফাইটিং যন্ত্র কেনা হবে। এই দুটি হচ্ছে মূল বিষয়। আর গত ৫ বছর ধরে সুন্দরবনে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয়েছে, তাতে দেখা যায়, সুন্দরবন দুই দিন পানির নিচে থাকে। এ কারণে অভয়ারণ্য এলাকাতে ১২টি কিল্লা স্থাপন করা হবে। কারণ সুন্দরবনে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাঘ, হরিণ পুকুরের পাশে অবস্থান নেয়। হরিণ কিল্লাতে আশ্রয় নিতে পারবে। জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতিতে চেষ্টা চলছে বাঘ এবং বাঘের শিকার করা প্রাণী কীভাবে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখা যায়।

উল্লেখ্য, আইইউসিএন বাঘকে পৃথিবীতে অতি সংকটাপন্ন প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৩টি দেশে ৩ হাজার ৮৪০টি বাঘ রয়েছে। ২০১৫ সালে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। আর ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা ১১৪টি। তার মধ্যে পূর্ণ বয়স্ক ৬৩টি, ১৮টি ১২ থেকে ১৪ মাস বয়সী এবং ৩৩টি শাবক।