এক সড়কে ২৩ জেলায় স্বস্তি

নিউজ ডেস্ক

সময় একাত্তর

প্রকাশিত : ০৩:২৭ পিএম, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সোমবার

এক সড়কে ২৩ জেলায় স্বস্তি

এক সড়কে ২৩ জেলায় স্বস্তি

সাভার থেকে টাঙ্গাইল মহাসড়কে উত্তরাঞ্চলের যাত্রীদের দুর্ভোগ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। রাস্তায় নেমে কে কখন গন্তব্যে পৌঁছাবে তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। দূরপাল্লার যাত্রীদের যানজটে আটকে থাকতে হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেই দুর্বিষহ দুর্ভোগের দিন শেষ হয়েছে। অবশেষে স্বস্তি ফিরে এসেছে উত্তরাঞ্চলের ২৩ জেলার লাখ লাখ যাত্রীর। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) বহুল আকাক্সিক্ষত ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা চার লেন মহাসড়কের (এন-৪) কাজ শেষ হয়েছে। পাশাপাশি সাভার-নবীনগর-চন্দ্রা সংযোগ সড়ক প্রকল্পের আওতায় প্রশস্ত সড়ক, উড়াল সেতু ও আন্ডারপাসের কারণে বদলে গেছে উত্তরের যোগাযোগ ব্যবস্থা। চোখ ধাঁধানো এই মহাসড়কের ওপর দিয়ে এখন যাতায়াত করছে দ্রুতগামী যানবাহন। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে চলাচলের সময় মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে- এটি কি বাংলাদেশ? না অন্য কোনো দেশ? প্রশস্ত মহাসড়কে যাতায়াতে এখন ভ্রমণের সময় অনেক কমেছে। ৩/৪ ঘণ্টার রাস্তা পাড়ি দেওয়া যাচ্ছে দেড়/দুই ঘণ্টায়। যাত্রী ও চালকদের মধ্যে ফিরে এসেছে স্বস্তি। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক কয়েক বছর আগেও ছিল ভাঙাচোরা ও দুই লেনের। যাত্রীদের যানজটে কেটেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অনেকের ঈদ কেটেছে রাস্তায়। চার লেনের মহাসড়কের কাজ সমাপ্ত হওয়ায় এবার স্বস্তিতে বাড়ি ফিরতে পারছেন উত্তরাঞ্চলসহ এই পথের যাত্রীরা। ঢেউ খেলানো ঝা চকচকে এই সড়কটিতে চলতে এখন স্বস্তি মিলছে। সড়কের মাঝে ইস্পাতের পাত দিয়ে রেলিং দেওয়া হয়েছে। বিস্তৃত সড়ক ডিভাইডারে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন ফুলের গাছ। রয়েছে উড়ালসেতু, স্টিলের ফুটওভার ব্রিজ, পুরনো সেতুগুলোর পাশে নতুন যে সেতু তৈরি হয়েছে সেখানেও সার্ভিস লেন করা হয়েছে। সার্ভিস লেনে স্থানীয় ধীরগতির যান চলাচল করছে। আন্ডারপাসগুলো দিয়ে স্থানীয় যানগুলো রাস্তার একপাশ থেকে অন্যপাশে যাতায়াত করছে।

সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) প্রকল্পের আওতায় জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার মহাসড়কে সাতটি উড়ালসেতু, দুটি রেলওয়ে ওভারপাস, ২৬টি স্টিল ফুটওভার ব্রিজ, ৫৩টি সেতু এবং ৭৬টি কালভার্ট এবং ১১টি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। বহুল আকাক্সিক্ষত এই  চার লেন মহাসড়ক গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পর থেকেই ঢাকার সঙ্গে যেন উত্তরবঙ্গের ও টাঙ্গাইলের দূরত্ব অনেকটাই কমে গেছে। টাঙ্গাইল থেকে চাকরিজীবী অনেকেই প্রতিদিন ঢাকায় গিয়ে অফিস করে আবার সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে পারছেন। তেমনি অনেকে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলে এসে অফিস করছেন।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ও আবুধাবি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্টের ঋণে গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত চার লেনের মহাসড়কটি তৈরি করা হয়েছে। ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মহাসড়ক নির্মাণে খরচ হয়েছে ৬ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা।

‘জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা সড়ক (এন-৪) চার লেন মহাসড়কে উন্নীতকরণ’ প্রকল্পের পরিচালক মো. ইসহাক বলেন, ‘মূল মহাসড়কটি চার লেনের। এর সঙ্গে দুই পাশে ধীরগতি ও স্থানীয় যানবাহন চলাচলের জন্য আরও দুটি লেন তৈরি করা হয়েছে। চার লেনের সড়কের মাঝে ও দুই পাশে স্টিলের রেলিং দেওয়া হয়েছে। এতে স্থানীয় মানুষ কিংবা কোনো গবাদিপশু চার লেনের সড়কে প্রবেশ করতে পারবে না। মহাসড়কটিতে সাতটি ফ্লাইওভার ও ১১টি আন্ডারপাস তৈরি করা হয়েছে। মহাসড়কের পাশে যেসব বাজার রয়েছে, শহর ও বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো রয়েছে, সেগুলোতে সড়ক প্রতিবন্ধক দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও মহাসড়কে রয়েছে ফুটওভার ব্রিজ, এসব অবকাঠামো ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের যানজট লাঘবের পাশাপাশি মহাসড়কের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও উন্নত করেছে।’ ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয় ২০১৩ সালে। কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। চার প্যাকেজে প্রকল্পটি দক্ষিণ কোরিয়ার, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের আটটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে বাস্তবায়ন করেছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক দিয়ে উত্তরবঙ্গের ২৩টি জেলাসহ অন্তত ২৬ জেলার ৯৬টি রোডের যানবাহন চলাচল করে থাকে। ঈদ বা পূজার সময় যানবাহন চলাচলের সংখ্যা অন্তত ১০ গুণ বেড়ে যায়।

এদিকে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার সাভারের নবীনগর ত্রিমোহনা গাড়ির জটে আটকে থাকা যাত্রীদের কাছে ‘যানজটের নবীনগর’ নামে পরিচিত। বছরের প্রায় প্রতিদিন এ মোড়ে যানজট লেগে থাকত। সেই নবীনগর বাইপাইল মোড়ের ‘দুর্নাম’ এখন ঘুচে গেছে। সাভার উপজেলার আশুলিয়ার নবীনগর মোড় আগের চেয়ে অনেক প্রশস্ত করা হয়েছে। এই কারণে চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকার সড়কটি খুলে দেওয়ায় সড়কে কোনো যানজট হয় না। এর সুফল পেতে শুরু করেছে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কে চলাচলকারীরা। সড়ক সংযোগ প্রকল্পের আওতায় সাভার-নবীনগর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা মহাসড়কের গাজীপুর অংশে নির্মিত কোনাবাড়ী ও চন্দ্রা উড়াল সড়ক, দুটি সেতু ও একটি আন্ডারপাস উদ্বোধন করা হয়েছে। আগের চিরচেনা জটের চেহারা পাল্টে গেছে এখানে। উত্তরবঙ্গের যাত্রীবাহী বাস, ট্রাকসহ ভারী যানবাহন সাভারে নবীনগর বাইপাইল ত্রিমোড়ে এসে থেমে যেত। কিন্তু এখন আর সেগুলো থামছে না। টাঙ্গাইল থেকে যেসব পরিবহন সাভারের দিকে যায় এবং সাভার থেকে যেসব পরিবাহন টাঙ্গাইল বা উত্তরবঙ্গের দিকে যায়, তারা ৪ লেনের সড়ক ব্যবহার করে দ্রুতগতিতে চলে যাচ্ছে। কোথাও তাদের থামতে হচ্ছে না। অন্যদিকে যে যানগুলো সাভারের নবীনগর হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করবে, সেগুলোও উড়াল সড়কের নিচে মাঝখান দিয়ে বের হয়ে চলে যাচ্ছে। আর যেসব পরিবহন নবীনগর থেকে উত্তরবঙ্গের দিকে যায়, সেগুলোও উড়াল সড়কে না উঠে বাম দিক দিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে স্বাচ্ছন্দ্যে চলে যেতে পারছে। হানিফ পরিবহনের চালক পরিমল কুমার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দাদা, জীবনে যত দিন ধইরা রাস্তায় গাড়ি চালাইতেছি এর মধ্যে চন্দ্রার যানজটের কারণে রাস্তায় বইসা থাকা লাগছে বেশি। সড়কটি চার লেন হওয়ার কারণে এখন আর যানজটে বইসা থাকা লাগছে না।’

এনা পরিবহনের হেলপার রাসেল মিয়া বলেন, ‘সাভারের নবীনগর, বাইপাইল ও চন্দ্রা এখন এত বড় হয়েছে আবার ফ্লাইওভারও (উড়ালসড়ক) হইছে। এখন আর অযথা জামে পড়তে হইতেছে না।’ ঢাকার জজ কোর্টের আইনজীবী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যানজটের ভয়ে আগে সেই কাকডাকা ভোরে রওনা দিতাম। কিন্তু আজ সকাল ৮টায় রওনা দিয়ে পৌনে ১০টায় আদালতের চেম্বারে পৌঁছে গেছি।’

সাভার পরিবহনের চালক তারেক মিয়া বলেন, চন্দ্রা ও নবীনগর এলাকার যানজট ছিল না। তবে ইপিজেড এলাকায় রাস্তার কাজ এখনো অনেক বাকি, যার কারণে সেখানে একটু ধীরগতিতে চলতে হয়েছে। চন্দ্রা ত্রিমোড় দিয়ে অনেক গাড়ি চলাচল করলেও কোথাও যানজট চোখে পড়েনি। চন্দ্রা সড়কের দুই পাশে যে বিশাল জায়গাজুড়ে সড়ক প্রশস্ত করা হয়েছে, সেটির কার্পেটিং বা আরসিসি ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়নি। সাভার হাইওয়ে পুলিশ ও জেলা পুলিশের সদস্যরা সড়কে দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন। সড়কে তিন চাকার কোনো হুইলার চলতে দেওয়া হচ্ছে না। কেউ উঠলেই সেগুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আবদুল্লাহিল কাফি  বলেন, ‘এই সড়কে কোনো সমস্যা নেই। তবে সমস্যা থাকলে চিহ্নিত করে সমাধান করার চেষ্টা করছি। তবে দুটি ৪ লাইন সড়ক থাকায় যানজট দূর হয়ে গেছে।’ ঢাকা জেলা পরিবহন শ্রমিক মালিক সমিতির সভাপতি আব্বাস উদ্দিন বলেন, ‘ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক চার লেন এবং চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকার সড়ক চার লাইন কারণে সড়কে যানজট নেই।’ উল্লেখ্য, সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম হলো ৫৫০ কিলোমিটার ৪, ৬, ও ৮ লেনের সড়ক নির্মাণ এবং ১১০০০ মিটার ফ্লাইওভার/ওভারপাস নির্মাণ। সাসেক প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়িত ৭০ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পটি ওই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নেরই একটি সংগতিপূর্ণ অংশ। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ ভবিষ্যতে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা দিয়ে ভারত ও নেপাল এবং লালমনিরহাটের বুড়িমারী দিয়ে ভারত ও ভুটানের সঙ্গে উপ-আঞ্চলিক সড়ক সংযোগ সহজতর হবে। সূত্র জানায়, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে স্বাচ্ছন্দ্যের পাশাপাশি আঞ্চলিক কানেকটিভিটির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে নতুন এই জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা চার লেন মহাসড়ক।