ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়ার আমল তাহাজ্জুদ

ধর্ম ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:৩১, ৩০ মে ২০২১  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

একবার আম্মাজান আয়েশা (রা.) দো-জাহানের সরদার হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি এত কষ্ট করছেন, অথচ আপনার পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে!’ রাত জেগে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পড়তে তার পা মোবারক ফুলে যেত, তাই এই অনুযোগ। উত্তরে নবীজী  (সা.) বলেছিলেন- ‘আমার কি উচিত নয় যে, (এই মহা অনুগ্রহের জন্য আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে) আমি একজন পূর্ণ শোকর আদায়কারী বান্দা হব?’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৩৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮২০)

কিয়ামুল লাইল- রাত জেগে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ, মুমিনের মর্যাদার সিঁড়ি। জান্নাতের যাওয়ার অন্যতম উপায়। সফলতার চাবিকাঠি। আল্লাহর একান্ত ও প্রিয় হওয়ার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। রাসূলে কারীম  (সা.) কখনও তাহাজ্জুদ ছাড়েননি। ছুটে গেলে কাযা করতেন। নিজে আদায় করতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকেও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উৎসাহিত করতেন।  

মুমিনের মর্যাদার সোপান
জিবরীল (আ.) আল্লাহর হুকুমে নবীজির খেদমতে আসতেন। আল্লাহ ও তার রাসূলের মাঝে ওহীর জ্ঞান ও ঊর্ধ্বজগতের খবর পৌঁছানোর গুরুদায়িত্বটা ন্যস্ত ছিল তার কাঁধে। নবীজীর কাছে আসতেন এবং কিছু উপদেশ ও নসীহত শুনিয়ে আবার সরে যেতেন মানবপরিবেশ থেকে। একদিন উপদেশ শোনানোর পর তিনি নবীজীকে একটি অসাধারণ দর্শন জানালেন- হে মুহাম্মাদ! মুমিনের মর্যাদা কিয়ামুল লাইল- রাতে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় ও বিভিন্ন বন্দেগীর মধ্যে, আর তার সম্মান মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষিতার মধ্যে। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৯২১; আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৪২৭৮

ফরজ নামাজের পরেই যার স্থান   
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মুমিনের পরিচয়। এর গুরুত্ব অপরিসীম। এর পরই যে নামাজ আল্লাহর কাছে প্রিয় তা হল তাহাজ্জুদ। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদীস; নবীজী (সা.) ইরশাদ করেন, রমজানের পর রোজা রাখার উত্তম সময় মুহাররম মাস আর ফরজ নামাজের পর উত্তম নামাজ রাতের নামাজ, অর্থাৎ তাহাজ্জুদ। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭২৫

যে আমল নবীজী কখনো ছাড়েননি
প্রিয় জিনিস কি কেউ কখনও ছাড়তে চায়? আর যদি সঙ্গে যুক্ত হয় মজবুত ঈমান ও সওয়াবের আশা, হৃদয়ে থাকে প্রভুর প্রতি ভালোবাসা এবং আমলের অদম্য প্রেরণা; তখন কঠিন কাজও হয়ে যায় অতি সহজ। হ্যাঁ, আমাদের জন্য এর সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত প্রিয়নবী (সা.)। তার জীবনসঙ্গীনী ও মুমিন-জননী হজরত আয়েশা (রা.) এর জবান থেকেই এর একটি বিবরণ শুনুন। উরওয়া (রাহ.) বলেন, আয়েশা (রা.) বলেন- (নবীজী) রাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এত বেশি নামাজ পড়তেন যে, তার পাও মোবারক ফুলে যেতো। এ দেখে তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এত কষ্ট করছেন, অথচ আপনার পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে! রাসূল (সা.) বললেন, ‘আমার কি উচিত নয় যে, (এই মহা অনুগ্রহের জন্য আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে) আমি একজন পূর্ণ শোকর আদায়কারী বান্দা হব?’-সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৩৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮২০

স্বেচ্ছায় তো ছাড়তেনই না, কখনো অনিচ্ছায় ছুটে গেলেও কাজা করে নিতেন। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) থেকেই বর্ণিত, রোগ-ব্যাধি কিংবা অন্য কোনো কারণে যদি রাসূল (সা.) তাহাজ্জুদ আদায় করতে না পারতেন, তবে দিনের বেলায় বারো রাকাত আদায় করে নিতেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৪৬

অন্য বর্ণনায় আছে, আবদুল্লাহ ইবনে কাইস (রা.)-কে হজরত আয়েশা (রা.) বললেন- হে আবদুল্লাহ! কিয়ামুল লাইল কখনো ছেড়ো না! কেননা নবীজী (সা.) তা কখনো ছাড়েননি। কখনো অসুস্থতা বা দুর্বলতা বোধ করলে বসে আদায় করতেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৩০৯

পাপ মুছে দেয়
তাহাজ্জুদ গোনাহ মিটিয়ে দেয় এবং মানুষকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে। হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলে কারিম (সা.) ইরশাদ করেন-তোমরা কিয়ামুল লাইলের প্রতি যত্নবান হও। কেননা তা তোমাদের পূর্ববর্তী সালেহীনের অভ্যাস এবং রবের নৈকট্য লাভের বিশেষ মাধ্যম। আর তা পাপরাশী মোচনকারী এবং গোনাহ থেকে বাধা প্রদানকারী। -জামে তিরমিযি, হাদীস ৩৫৪৯; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১১৫৬

কিয়ামুল লাইল: জান্নাতীদের বৈশিষ্ট্য 
পবিত্র কোরআনে মুত্তাকীদের জন্য জান্নাতের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সেদিন নিশ্চয়ই মুত্তাকীরা থাকবে প্রস্রবণবিশিষ্ট জান্নাতে। -সুরা যারিয়াত (৫১) : ১৫
সঙ্গে তাদের কিছু গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যের বিবরণও এসেছে। তন্মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল- রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত। -সুরা যারিয়াত (৫১): ১৮

ইবাদুর রহমান-রহমানের বান্দাদের কতিপয় বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে কোরআনুল কারীমের সুরা ফুরকানে। সেখানেও উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যটি বিবৃত হয়েছে- আর তারা রাত অতিবাহিত করে তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদারত হয়ে এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। -সুরা ফুরকান (২৫) : ৬৪

সুরার শেষের দিকে তাদের পুরস্কারের বিবরণও এসেছে- তাদের প্রতিদান দেয়া হবে জান্নাতের সুউচ্চ কক্ষ। কারণ তারা ছিল ধৈর্যশীল। তাদেরকে সেখানে অভ্যর্থনা করা হবে অভিবাদন ও সালাম সহকারে। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আশ্রয়স্থল ও বসতি হিসেবে তা কত উৎকৃষ্ট! সুরা ফুরকান (২৫) : ৭৫-৭৬

কিয়ামুল লাইল : জান্নাত লাভ ও মর্যাদা বৃদ্ধির আমল
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) যখন মদীনায় এলেন, মানুষের সঙ্গে আমিও তাকে একনজর দেখবার জন্য বের হলাম। তার চেহারা মোবারকের দিকে যখন তাকালাম, আমার বিশ্বাস হয়ে গেল, এ কোনো মিথ্যাবাদির চেহারা হতে পারে না। তখন তার মুখে সর্বপ্রথম আমি যে কথাগুলো শুনেছি- হে লোকসকল! সালামের প্রসার কর। মানুষকে আহার করাও! আর রাতে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে, তখন তুমি নামাজ আদায় কর! তবেই নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। -জামে তিরমিযি, হাদীস ২৪৮৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩২৫১ 

অন্য হাদীসে পাওয়া যায়, উপরোক্ত গুণাবলি যাদের মধ্যে বিদ্যমান থাকবে, জান্নাতে থাকবে তাদের জন্য বিশেষ মর্যাদা। হজরত আবু মালেক আশআরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- নিশ্চয়ই জান্নাতে রয়েছে এমন কিছু কক্ষ/প্রাসাদ, যার বাহির থেকে ভেতরাংশ দেখা যাবে, ভেতর থেকে বহিরাংশ দেখা যাবে। এগুলো আল্লাহ তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন, যারা মানুষকে খাবার খাওয়ায়, কোমল ভাষায় কথা বলে, ধারাবাহিকভাবে রোজা রাখে, সালামের প্রসার ঘটায় এবং রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তারা নামাজে দন্ডায়মান থাকে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৯০৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫০৯; জামে তিরমিযি, হাদীস ২৫২৭

কিয়ামুল লাইল : কিছু আদব
অন্য সকল আমলের মতো এই ফযীলতপূর্ণ আমলটির ক্ষেত্রেও কিছু আদব ও নিয়ম-নীতি রয়েছে :

চোখ মুছে নেয়া এবং দুআ পড়া

ইবনে আব্বাস (রা.) নবীজীর রাতের আমল প্রত্যক্ষ করার জন্য তার খালা উম্মুল মুমিনীন মায়মুনা (রা.)-এর ঘরে ছিলেন। তিনি বলেন, দেখলাম- রাসূল (সা.) ঘুম থেকে উঠে দুই হাত দিয়ে চোখ মুছে ঘুম দূর করলেন এবং সুরা আলে ইমরানের শেষ দশ আয়াত তিলাওয়াত করলেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৬৩

মিসওয়াক করা
হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা.) রাতে যখন তাহাজ্জুদের জন্য উঠতেন, তখন ভালো করে মিসওয়াক করতেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৩৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫১৬

হজরত আলী (রা.) বলেন- কেউ যখন রাতে তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য ওঠে এবং মিসওয়াক করে অযু করে, অতঃপর নামাজে দন্ডায়মান হয় তখন ফেরেশতা তিলাওয়াত শোনার জন্য পিছনে দাঁড়িয়ে যায়। এরপর ফেরেশতা তার নিকটবর্তী হতে থাকে; একপর্যায়ে খুব নিকটে চলে আসে এবং ব্যক্তির মুখে মুখ রেখে দেয়। তখন সে যা তিলাওয়াত করে ফিরিশতার উদরে চলে যায়। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১৮১০; ফাযলু কিয়ামিল লাইল, আজুররী, হাদীস ৩৫

প্রথমে হালকা দুই রাকাত দিয়ে শুরু করা
প্রথমে ছোট সুরা দিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে দুই রাকাত আদায় করবে। কারণ রাসূল (সা.) এমনটি করতেন। আম্মাজান আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) রাতে যখন নামাজের জন্য উঠতেন- শুরুতে হালকা করে দুই রাকাত আদায় করতেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭৫৬; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৬৬৮২ 

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজী (সা.) ইরশাদ করেন- তোমাদের কেউ যখন রাতে উঠবে, সে যেন প্রথমে হালকা দুই রাকাতের মাধ্যমে শুরু করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৬৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৩২৩

সর্বশেষ
জনপ্রিয়