ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

কবি মজিদ মাহমুদের বই: ‘মাহফুজামঙ্গল’

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৪:৩৮, ১৭ এপ্রিল ২০২১  

ছবি : সংগৃহীত

ছবি : সংগৃহীত

কবি মজিদ মাহমুদ যখন ‘মাহফুজামঙ্গল’ লিখেছেন; সেসময় আমি রাশি রাশি লাল মলাটের বই পড়ি। কবিতা বলতে ‘ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠিয়েছ সংসারে, বিশ্ব ছাড়ায়ে আমি উঠিয়াছি একা... কিংবা এই পৃথিবীর এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি ইত্যাদি থেকে সীমানা ছাড়িয়ে নেরুদা, মায়াকোভস্কি পর্যন্ত পৌঁছে গেছি। সমাজ সভ্যতা ইতিহাস নির্ভর গল্প উপন্যাসের বাইরে প্রেমের কবিতার দিকে তাকাই অবজ্ঞা ভরে, আপন মনে ভাবি ফুল পাখি পাহাড় চাঁদ মাছ আকাশ এসবের বাইরে অন্য কিছু কি নেই। চারপাশের হাহাকার হানাহানি দুঃখ-বেদনা বেঁচে থাকার লড়াই এর মাঝে প্রেমময়তা আসে কিভাবে মানুষের। বিশেষ করে মধ্যবিত্তের কাব্যকল্পনা নিয়ে ঠাট্টা-মশকারা করতাম। সব মিলিয়ে সে সময় আমি ‘মাহফুজামঙ্গল’ পড়িনি।

কবির কবিতা যেমন জীবনের বাইরে নয় পাঠকের ভাবনার অনুভূতিও তাই। আমার ব্যক্তি জীবন কাব্যময় নয় বরং গদ্যময়। কবিতা পড়ি ইদানিং বলা যায় ত্রিশ বছর বয়স পেরিয়ে। কবিতা অনেক সময় বুঝতে পারি না সে ক্ষেত্রে কেউ কেউ বলেন কবিতা না-কি বোঝার জিনিস নয়। যেমনটা চিত্রশিল্পীরা বলেন চিত্রকলার ক্ষেত্রে।

এখন আসি ‘মাহফুজামঙ্গল’ প্রসঙ্গে। কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে- প্রচলিত অপ্রচলিত কাব্যরীতি, মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য অথবা বর্তমান সাহিত্যরীতি, ধর্মীয় ভাবধারা, সুফীবাদ বা বৈষ্ণববাদ, কবিতায় কবির প্রয়োগকৃত উপমা, রাজনীতি সচেতনতা দেশকালের সীমনা পেরিয়ে বিশ্বভাবনা ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিক হলেও আমি দূরে সরিয়ে রেখেছি। ভিন্ন রকম ভাবনা মাথায় নিয়ে লিখতে বসেছি, লেখা সঙ্গত বা অসঙ্গত কি-না জানি না। কবি তার প্রথম কবিতা কুরশিনামায় লিখেছেন- আমি এখন ঘুমে জাগরণে জপি শুধু তোমার নাম। প্রেমিক কবি তার কাব্যলক্ষ্মীকে কল্পনা করেছেন ঘুমে এবং জাগরণে। কবির মাহফুজা ঈশ্বর প্রেমের সমান্তরালে এসে দাঁড়িয়েছে। কবি শিল্পী সাহিত্যিকসহ সৃজনশীল মানুষেরা সুন্দরের আরাধনায় মুগ্ধতার সাথে মগ্ন হয়ে কাব্যলক্ষ্মীকে স্মরণ করে না।

বিসদৃশভাবে আমার মনে ভিন্ন রকম ভাবনার আলো-আঁধারির খেলা চলে। উন্মুক্ত ভ্যানগাড়িতে শুয়ে আছে ফ্রকপরা কিশোরী মেয়ের লাশ। সময়টা ১৯৯৩। দিনাজপুর থেকে ঢাকায় বাসাবাড়ির কাজে এসেছিল মেয়েটি সামান্য পেটপুরে খাবার আর একটু আশ্রয়ের আশায়। উজ্জ্বল নগরীর বন্দীত্ব থেকে আবার ফিরে গিয়েছিলো দিনাজপুরে। উর্দিপরা কিছু ভুল মানুষের নোংরা আলিঙ্গনে প্রাণ হারিয়েছিলো এখানেই ঘটনার দাঁড়ি টানা যেতো তা হয়নি। পেশাদার যৌনকর্মী সাজিয়ে তার মৃত্যুকে জায়েজ করতে চেয়েছিলো প্রশাসন। দিনাজপুরই রুখে দাঁড়িয়েছিলো এরপর গোটা দেশ! পারুল বোনের জন্য অঝোরে প্রাণ দিয়েছিলো আমাদের ভাইয়েরা।

কবি মজিদ মাহমুদের মাহফুজার পাশে এসে দাঁড়ায় আবার বোন ইয়াসমিন। কবি যখন লেখেন- ঈশ্বরের প্রতিনিধি হয়ে স্বশরীরে তুমি থাকো রোজ কাছে, তখন তাজরীনের পুড়ে যাওয়া কয়লা শরীরগুলো যারা ডিএনএ পরীক্ষার আশায় জুরাইনের সবুজ ঘাসের নিচে শুয়ে আছে তাদের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে রানাপ্লাজার মাটিতে মিশে থাকা অসংখ্য ঈশ্বরের প্রতিনিধির কথা। আবারো কবিতায় ফিরে যাই মনযোগ দিয়ে পড়ি- তুমি ছাড়া আর কোন প্রার্থনায় আমার শরীর এমন একাগ্রতায় হয় না নত। আমি কবিতা পড়ি আমার মস্তিষ্ক আমাকে ভিন্ন ধরনের সংকেত পাঠায়, আমি দেখতে পাই হাত-পা বেঁধে আমার মেয়ে নুসরাতকে ওরা যূপকাঠে নিয়ে যাচ্ছে। আমি কবিতা পড়ি আবার পড়ি-
‘আমি জানি না এমন মারি আর মড়কের দেশে
কেমন বিশ্বাসে তুমি নড়ে ওঠো গোলাপের ঠোঁট’ (মাহফুজামঙ্গল-৩)
কিংবা
‘একদিন আসবে দিন আমাদের বেদীনের দেশে’ (একদিন আসবে)
আমার আমিকে বলি দেখো কি চমৎকার উপমা ও আঙ্গিক-
‘ডিমের ভেতর থেকে চঞ্চুতে কষ্ট নিয়ে উড়ে যাচ্ছে কিন্তু কেউ দেখছে না পানির নিচে বিছিয়ে দেয়া তোমার কোমল করতল আমাকে মাছের মতো ভাসিয়ে রেখেছে।’ (নদী)

পড়তে পড়তে ভাবি চিরকালই সংস্কৃতিবান মানব তার প্রিয় মানবীর মাঝে খুঁজে ফিরেছে সুন্দরের স্বপ্ন। মানসীর খোঁপায় পরিয়ে দিতে চেয়েছে তারার ফুল। ঘুমন্ত রাজকন্যার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে সোনার কাঠি রূপার কাঠির ছোঁয়ায়। আবার লোলুপ পুরুষ রাতের আঁধারে বাস স্টপেজ থেকে কোন নারীকে মুখ চেপে ধরে নিয়ে নিজের পশুত্বকে জাহির করে, যা পশুরাও করে না। সুন্দরের বিপরীতে এ কোন অসুন্দরের খেলা! মানব চরিত্রের এ কোন অসুন্দরের খেলা! মানব চরিত্রের এ কোন অসুন্দর দিক। যার জন্য বারবার নারীকে সীমাহীন মূল্য দিতে হয়। সন তারিখের হিসেব করলে বেশি পেছনে নাইবা গেলাম, একাত্তর একানব্বই থেকে নতুন শতকের উনিশ বিশ সাল পর্যন্ত কোনদিন বন্ধ থাকেনি অসুরদেও নর্তনকুর্দন। সে কারণেই ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘মাহফুজামঙ্গল’ কাব্যে সংযোজিত হয় যুদ্ধমঙ্গলের সাতটি সময়োপযোগী কবিতা। সাতটি কবিতা নতুন পালক সংযোজন করে কাব্যগ্রন্থের মুকুটে। সেখানে মজিদ মাহমুদ যিনি শুধু ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ তা নন, একই সঙ্গে সমাজ ও রাজনীতি সচেতন একজন ব্যক্তি। যিনি উচ্চারণ করেন একুশ শতকের বাস্তবতাকে- মাহফুজা যুদ্ধকে অস্বীকার করতে পারে বলো? (যুদ্ধমঙ্গল ১)
আমাদের সামনে শত্রুর তরবারি
পিছনে ততোধিক নিষ্ঠুর সম্রাট বাহিনী। (যুদ্ধমঙ্গল ২)

তুমি কি বলবে যুদ্ধ ও রাষ্ট্র তাহলে সমার্থক?
তাহলে আমি বলি দুটিরই অবসান হোক তবে। (যুদ্ধমঙ্গল ৪)

সমাজ সচেতন কবি মজিদ মাহমুদ বর্তমানকে অস্বীকার করেননি। চমৎকারভাবে আমাদের সময়কে তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন। কোথাও কোথাও নারী প্রশ্নে পুরুষতান্ত্রিকতার প্রশ্নে কিছু শব্দ বাক্য ভিন্ন আঙ্গিকে খেলা করে আমার মনোজগতে। যেমন-
‘এমন অযোগ্য কবিকে তুমি সাজা দাও মাহফুজা
যে কেবল খুঁজেছে তোমার নরম মাংস।
স্বর্গের বেশ্যা তুমি লাস্যময়ী নৃত্য পটিয়সী (সংগীতের ভেতর)

কবি মাহফুজাকে কখনো পরমাত্মার সমান্তরালে তুলনা করেছেন। কখনো বা দেবী রূপে আবার দু’একটি প্রচলিত শব্দ দিয়ে ধুলিমাটির প্রচলিত ক্লেদাক্ত জীবনের কথা পাঠককে মনে করে দিয়েছেন। কবির জন্য শুভ কামনা। বেঁচে থাক ‘মাহফুজামঙ্গল’ পাঠক হৃদয়ে।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়