ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৪ ১৪৩০

কমিটি বাণিজ্যে বকুলের মাধ্যমে টাকা যাচ্ছে তারেক রহমানের কাছে

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৯:৪১, ১১ এপ্রিল ২০২১  

তারেক রহমান : ফাইল ছবি

তারেক রহমান : ফাইল ছবি

বিএনপির দুই অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদল এবং যুবদল রাজনীতির মাঠে নিয়মিত সক্রিয় না থাকলেও অঙ্গ সংগঠনগুলোর বিভাগীয় পর্যায়ে চলছে কমিটি বাণিজ্য। বিক্রি হচ্ছে সাংগঠনিক পদ, টাকা তোলা হচ্ছে ‘ভাইয়ার’(তারেক রহমান) নামে । একই পদে একাধিক প্রার্থীর মধ্যে যে বেশি টাকা দিচ্ছে তাকেই পদ দেয়া হচ্ছে। আর এসব টাকার বড় একটা অংশ যাচ্ছে লন্ডনে। জানা গেছে, হাওয়া ভবনের সাবেক কর্মকর্তা রকিবুল ইসলাম বকুল টাকা লেনদেনের বিষয়টি অত্যন্ত সতর্কতার সহিত নিয়ন্ত্রণ করছেন। সম্প্রতি যুবদলের খুলনা বিভাগের উপজেলা সমূহের কমিটি গঠন সম্পন্ন হয়েছে। এসব কমিটিতে টাকা দিয়েও পদ না পাওয়া অনেকেই অভিযোগ নিয়ে ঘুরছেন নেতাদের কাছে। ভাইরাল হয়েছে টাকা লেনদেনের স্ক্রিনশর্টও।

বাংলা নিউজ ব্যংকের অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তৃণমূলকে শক্তিশালী করতে যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের নেতৃত্বে আনতে দেশের সকল বিভাগের মতো খুলনার ছাত্রদল ও যুবদলের টিম গঠন করে দেন। তবে খুলনার টিম চলছে ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও হাওয়া ভবনের সাবেক কর্মকর্তা রকিবুল ইসলাম বকুলের নির্দেশেই। তারা টিমে তাদের ক্যাশিয়ার নিয়োগ করে পদ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা আয় করছেন।

সূত্রমতে, বিএনপি হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে ত্যাগী ও যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে ছাত্রদল ও যুবদল পুনর্গঠনের জন্য পৃথক টিম গঠন করে দেয়া হয়েছে। আর এসব টিমের বিরুদ্ধেই উঠেছে অভিযোগ। নগদ টাকা, মদ-ফেনসিডিল ও উপঢৌকনের বিনিময়ে পদ বিক্রির একাধিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ সংক্রান্ত অডিও রেকর্ড, হোয়াটসএ্যাপে টাকা নিয়ে দরকষাকষি এবং বিভিন্ন নিউজ পোর্টাল এবং ফেসবুকে ভুক্তভোগীদের ক্ষোভ সংক্রান্ত স্ক্রিনশর্টসহ বিভিন্ন প্রামাণ্য তথ্য প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।

সংগঠনের স্থানীয় নেতারা জানান, যুবদলের খুলনা বিভাগীয় টিমের পদ বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। এই টিমে বকুলের ক্যাশিয়ার হিসাবে মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও খুলনা মহানগর যুবদলের সভাপতি মাহবুব হাসান পিয়ারু এবং খুলনা জেলা যুবদলের সভাপতি শামীম কবির। টিমে আরো ৫ জন আছেন। তারাও কমবেশি বাণিজ্য করছেন। তবে সেটা গোপনে। আর শামীম-পিয়ারু প্রকাশ্যে টাকা তুলছেন বকুলের নামে।

যুবদলের খুলনা টিমের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বকুল বলেছে, টাকা তুলে ‘ভাইয়াকে’ লন্ডনে পাঠানো হচ্ছে। সব বিভাগীয় টিম টাকা তুলছে। ভাইয়া (তারেক জিয়া) ফান্ড রেইজ করছেন। এটা পার্টির দুর্দিনে লাগবে। গত ১৪ মার্চ সাতক্ষীরার ৮টি উপজেলা যুবদলের কমিটি ঘোষণা হয়েছে।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, ইতোমধ্যে বিভাগের উপজেলাগুলো থেকে দুই কোটি টাকার বেশি পদ বাণিজ্য করে বকুলকে দিয়েছে শামীম কবির ও পিয়ারু। যেসব এলাকায় কমিটি এখনো প্রক্রিয়াধীন সেসব এলাকার পদপ্রত্যাশী নেতাদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিচ্ছে তারা।

এর মধ্যে ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ও আমাদের হাতে আসা প্রমাণে দেখা যাচ্ছে, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার দুই যুবদল নেতার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকাসহ কয়েক দফা সদলবলে সাতক্ষীরার সীমান্ত ভোমরা গিয়ে ফেনসিডিল খেয়ে তাদের পদে এনেছে শামীম-পিয়ারু ও খুলনা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ইবাদুল হক রোবায়েদ।

এছাড়া তারা ৫০ বোতল ভারতীয় ফেনসিডিল নিয়ে এসেছে। এই তিনজনই খুলনায় বকুলের ম্যান হিসাবে পরিচিত। শামীম কবিরের ‘হোয়াটসএ্যাপে’র কথোপকথনে শুনা যায়, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার একজন আহ্বায়ক পদ প্রার্থী তাকে বলছেন আমার ব্যাপারটা মাথায় আছে তো ভাই?

শামীম কবির বলছেন, আমি আগেই কিন্তু সব ক্লিয়ার করে বলেছিলাম। আতিয়ার-মন্টু ১০ লাখ টাকা খরচ করেছে। বিভাগীয় টিমের সবাইকে খরচ দিয়েছে। আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম ৫ লাখ টাকা দাও। বাকিগুলো আমি ম্যানেজ করে নেব। এরপর সেই আহ্বায়ক পদপ্রার্থী বলছেন ’আপনার কথামতো ৫ লাখ টাকা আমি একবারে দেয়নি। ৫ হাজার, ১০ হাজার করে ২ লাখ টাকা দিয়েছি। আপনি আমাকে তালা যুবদলের আহ্বায়ক বানান, তারপর পুষায় দিব, সমস্যা হবে না। জবাবে শামীম কবির বলছেন, চেষ্টা করব। রাতে হোয়াটসএ্যাপে কল দেব।

উল্লেখ্য, গত ১৪ মার্চ তালা উপজেলা কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে আহ্বায়ক করা হয়েছে মির্জা আতিয়ার রহমানকে ও সদস্য সচিব করা হয়েছে শেখ মোস্তফা হোসেন মন্টুকে। খালিদ আহমদকে করেছে সাইনিং পাওয়ারসহ ১নং যুগ্ম আহ্বায়ক।

তালা কমিটিতে সদস্য পদ পাওয়া এক নেতা বলেন, শামীম কবিরকে নগদ ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। শামীম বলেছিল যুগ্ম আহ্বায়ক করবে। কিন্তু করেনি । এখন আমি টাকা চাইলে বলছে, টাকা বকুল ভাইকে দিয়েছি। তার সাথে হোয়াটসএ্যাপে কথা বলো। আমি বকুল ভাইকে বহুবার ফোন দিয়েছি। একদিন বিকালে ফোন রিসিভ করলেও আমার নাম শুনে অসুস্থ বলে ফোন কেটে দিয়েছেন। আর ফোন ধরেননি।

বকুলের ঘনিষ্ঠ এক নেতা জানান, আমাদের জানামতে, তালা উপজেলা কমিটির ইয়াসিন-আতিয়ার-খালিদসহ ১৪ জন যুগ্ম সম্পাদকের কাছ থেকে অন্তত ৩০ লাখ টাকার পদ বাণিজ্য করেছে শামীম কবির। এর মধ্যে রকিবুল ইসলাম বকুলকে দিয়েছে ২০ লাখ টাকা। এ সংক্রান্ত বেশকিছু তথ্য আমাদের হাতে রয়েছে। যুবদলের মাহবুব হাসান পিয়ারুর ঘনিষ্ঠ একজন নেতা জানান, শামীম ও পিয়ারু বাগেরহাটের বাগেরহাট সদর, ফকিরহাট, মোললাহাট, চিতলমারী, কচুয়া, মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, রামপাল, মোংলার কমিটি বাণিজ্যের পরিমাণ ১২-১৪ লাখ টাকা।

শামীমের ঘনিষ্ঠ এক নেতা জানান, যশোরের কেশবপুর যুবদলের তিন নেতার কাছ থেকে অগ্রিম ৬ লাখ টাকা নিয়েছে। অভয়নগর থেকে ৫ লাখ। বাগেরহাটের তিন থানা থেকে ৯ লাখ। যশোর সদর, বাঘারপাড়া, অভয়নগর, মনিরামপুর, কেশবপুর, ঝিকরগাছা, শার্শা, চৌগাছা থেকে ১০-১২ লাখ টাকার চাঁদাবাজি করেছে। খুলনার দীঘলিয়া, রূপসা, তেরখাদা, দীঘলিয়া, ফুলতলা, ডুমুরিয়া, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা, কয়রা, দাকোপ উপজেলার কমিটিতে পদ বিক্রি করে ২০-২৫ লাখ টাকা নিয়ে বকুলকে দিয়েছে। ঝিনাইদহ সদর, শৈলকুপা, হরিণাকুণ্ডু, কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর, মহেশপুর থেকে ১৪-১৫ লাখ টাকা, কুষ্টিয়া সদর, কুমারখালী, খোকসা, মিরপুর, ভেড়ামারা ও দৌলতপুর থেকে চাঁদাবাজি কম করেছে। কারণ বকুলের বাড়ি এই জেলার ভেড়ামারায়। চুয়াডাঙ্গা সদর, আলমডাঙ্গা, দামুড়হুদা জীবননগর, মেহেরপুর সদর, গাংনী, মুজিবনগর থেকে কত চাঁদাবাজি করেছে তা জানা যায়নি।

যুবদলের একজন কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতা জানান, খুলনা বিভাগীয় টিম নিয়ন্ত্রণ করছেন বকুল গ্রুপ। সে মূলত তারেক জিয়ার নাম ভাঙ্গিয়ে কমিটি বিক্রি করে অর্থের পাহাড় গড়ছে। হাওয়া ভবনের সাবেক কর্মকর্তা বকুলের কোনো ব্যবসা বাণিজ্য না থাকলেও গুলশানের নিকেতন প্রজেক্টে বিশাল ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকেন। বাড্ডা-রামপুরাসহ ঢাকায় কয়েকটি এলাকায় জমি প্লট কিনেছেন। তার রয়েছে দামি গাড়ি। তারেক রহমানের নাম ভাঙ্গিয়ে বিএনপির বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলেন। তদ্বির ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অঢেল সম্পদ অর্জনের তথ্য দুর্নীতি দমন কমিশনে সম্প্রতি জমা দিয়েছে তার প্রতিপক্ষের লোকজন।

এ বিষয়ে রকিবুল ইসলাম বকুলের সাথে কথা বলার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তার চাঁদাবাজির বিষয়টি এখন দলে ওপেন সিক্রেট।

গত ৮ জানুয়ারি ছাত্রদলের খুলনা জেলার ২৯ ইউনিট কমিটি ঘোষণা হয়েছে। এই কমিটিগুলো থেকে প্রায় ৫০ লাখ টাকার বাণিজ্য করেছে হেলাল-বকুল। তাদের ক্যাশিয়ার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছে খুলনা জেলা ছাত্রদলের সভাপতি আব্দুল মান্নান মিস্ত্রি ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা তুহিন। দাকোপ, বটিয়াঘাটা ও দীঘলিয়া ও পাইকগাছা ছাত্রদলের কমিটি করা হয়েছে অছাত্র- মাদকসেবী ও বিবাহিতদের দিয়ে।

দীঘলিয়া উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মনিরুল গাজী দুই সন্তানের জনক। সদস্য সচিব এক সন্তানের জনক। গত ৮ জানুয়ারি ছাত্রদলের খুলনার ২৯টি টিমের কমিটি ঘোষণার পর বঞ্চিতরা রকিবুল ইসলাম বকুল ও আজিজুল বারী হেলাল এবং তাদের ক্যাশিয়ার আব্দুল মান্নান মিস্ত্রি ও গোলাম মোস্তফা তুহিনের বিরুদ্ধে জুতা মিছিল করেছে ও তাদের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে। বঞ্চিত ছাত্রদল নেতারা জানান, খুলনা জেলার অধিভুক্ত ২৯টি ইউনিট কমিটি থেকে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা হেলাল-বকুলকে দিয়েছে। আব্দুল মান্নান মিস্ত্রি ও গোলাম মোস্তফা তুহিন নিয়েছে মোটরসাইকেল।

ছাত্রদলের খুলনা টিমের এক সদস্য জানান, এই জেলার টিম ত্যাগী ও যোগ্য নেতা বাছাই করে কমিটি জমা দিয়েছিল। কিন্তু সেই কমিটি হেলাল-বকুল ছিঁড়ে ফেলে। তারা প্রভাব খাটিয়ে যাদের কাছ থেকে নগদ টাকা নিয়েছে তাদের নামে পৃথক কমিটি করে কেন্দ্র থেকে অনুমোদন করিয়ে নেন। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগীরা তারেক রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি।

এদিকে ছাত্রদলের মহানগর কমিটি ঘোষণা হয়েছে গত ২৪ মার্চ রাতে। ৩১ সদস্যের এই কমিটিতে আহ্বায়ক, সদস্য সচিবসহ অধিকাংশ পদে বকুল গ্রুপের নেতাদের রাখা হয়েছে। এদের অনেকে সরাসরি বকুলকে অর্থ দিয়ে পদ কিনেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুর সমর্থক নেতারা। তারা বলেছেন, বকুল তারেক রহমানের দোহায় দিয়ে এই কমিটি কেন্দ্র থেকে ছাড় করিয়ে নিয়েছে। যোগ্য নেতাদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয়নি।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়