ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৫ ১৪৩০

বিপদে সবর করলে পুরস্কার পাওয়া যাবে জান্নাত

ধর্ম ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:৫২, ২২ মে ২০২১  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

এই পৃথিবীতে কত মানুষ বসবাস করে। নানা বর্ণের মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে। কেউ আছে সুখের সাগরে আর কেউ আবার দুঃখের অতল গহ্বরে নোনা জলে হাবুডুবু খায়। তবুও মানুষ বেঁচে থাকে জীবন মায়ার আঁচল ধরে। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে বিভিন্ন অবস্থায় রেখে পরীক্ষা করেন।কাউকে সুখ দিয়ে পরীক্ষা করেন । আর অনেককে দুঃখের দরিয়া পার করান। সর্বাবস্থায় তাকদিরের ফায়সালায় সন্তুষ্ট থাকা। হা হুতাশ না করা। ধৈর্য ধরে আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করা।

বিপদ আল্লাহ তায়ালার পরীক্ষা
দুঃখ-বেদনা বিপদ আর কষ্টের ধরণও অনেক। দেহ-মন, অর্থসম্পদ ও সম্মান-আভিজাত্য ইত্যাদি কত দিক থেকে মানুষ বিপদের মুখে পড়ে। কেউ হয়তো শারীরিকভাবে অসুস্থ, কেউ পারিবারিক কারণে গভীর দুশ্চিন্তার শিকার। আবার কারও দীর্ঘদিনের অর্জন সামাজিক সম্মানটুকু কখনো মুহূর্তে ধুলোয় মিশে যায়। এ সবই মানুষের বিপদ। জীবনে বিপদ আসবেই। আল্লাহ তায়ালার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব (কখনো) ভয়-ভীতি, (কখনো) ক্ষুধা দিয়ে এবং (কখনো) জানমাল ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে, আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা: ১৫৫)

অন্য আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিনের ঘোষণা, ‘তোমরা তোমাদের জান-সম্পদের ক্ষেত্রে অবশ্যই পরীক্ষার মুখোমুখি হবে। আর তোমরা তাহলে কিতাব ও মুশরিকদের পক্ষ থেকে অনেক পীড়াদায়ক কথা শুনবে। তোমরা যদি ধৈর্য ও তাকওয়া অবলম্বন করো, তাহলে অবশ্যই তা বড় সাহসিকতার কাজ।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৮৬)

পবিত্র কোরআনের এ দ্ব্যর্থহীন ঘোষণায় সন্দেহের অবকাশ নেই। জীবনের নানা ক্ষেত্রে বিপদ আসবেই। নানা ধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। সেই পরীক্ষায় সফল হওয়ার মূলমন্ত্রও পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে। সফলতার সেই মূলমন্ত্রের নাম সবর বা ধৈর্যধারণ। ছোট-বড় যেমনই হোক, বিপদ তো বিপদই। কেউ যখন বিপদে পড়ে; বিপদের মর্ম সেই বুঝে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি যদি কোনো দুর্ঘটনায় আকস্মিক মৃত্যুবরণ করে, তাহলে তার পরিবারের জন্য তা যেমন মহাবিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তেমনি নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে জুতাটি জায়গামতো না পাওয়াও একটি বিপদ। প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয়টি নগণ্য। কিন্তু সময়মতো এক জোড়া জুতা না পাওয়া যে কত সংকটের সৃষ্টি করতে পারে তা ভুক্তভোগীই অনুভব করতে পারেন।

যে কোনো বিপদে ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়া
ছোট-বড় সব সংকটে মুমিনের মুখ থেকে তাই উচ্চারিত হয় ‘ইন্নালিল্লাহ!’ রাসূল (সা.) এর শিক্ষাও কত বিস্তৃত দেখুন। তিনি বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কারও জুতার ফিতা ছিঁড়ে যায়, তখনো তোমরা ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়ো। কেননা এটাও একটা বিপদ।’ (শুআবুল ঈমান, বায়হাকি, হাদিস: ৯২৪৪; মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস: ৩৪৭৫)

যে কোনো ধরনের বিপদে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে ইন্নালিল্লাহ পড়া ধৈর্যশীলদের পরিচায়ক। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা তাই বলেছেন, ‘যারা যে কোনো রকম বিপদে আক্রান্ত হলে বলে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ সন্দেহ নেই, আমরা আল্লাহরই, আর আমরা তো তার কাছেই ফিরে যাব।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৬) 

বিপদে সবর করা ও সবরের ব্যাখ্যা
আমরা যে সবরের কথা বলি সেটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো, শরিয়তে নিষিদ্ধ সব রকম কাজে জড়ানো থেকে নিজেকে বিরত রাখা। বিপদের মুখেও এমন কোনো কাজ না করা, শরিয়ত যেটির অনুমতি দেয়নি। যেমন কারও মৃত্যুতে বিলাপ করা। দুঃখ-কষ্টে জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা। আল্লাহ তায়ালার ব্যাপারে অসংগত কোনো বিশ্বাস পোষণ করা ইত্যাদি। এসবে না জড়িয়ে দয়াময় আল্লাহর ফয়সালাকে মেনে নিয়ে তার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করার নামেই সবর। সবর মুমিনের হাতিয়ার। পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা, ‘হে মুমিনরা! তোমরা সবর ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় আল্লাহ সবরকারীদের সঙ্গে রয়েছেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৩) 
সাধারণ বিপদেও আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার

মুমিন বান্দা দ্বীনের পথে চলতে গিয়ে বা কথা বলতে গিয়ে বিপদের মুখোমুখি হতে পারে। তবে যদি সবর করে, তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে পুরস্কৃত করবেন এটাই স্বাভাবিক কথা। কিন্তু দ্বীনের সঙ্গে সামান্য সম্পর্কও নেই, এমন ব্যক্তিগত কিংবা পার্থিব বিষয়েও যদি কেউ বিপদাক্রান্ত হয়ে সবরের পরিচয় দেয়, তখনো তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কারের ঘোষণা।

হাত থেকে পড়ে কাচের দামি গ্লাসটা ভেঙে গেল, কিংবা বন্যার পানিতে মাঠভরা পাকা ধান তলিয়ে গেল, রাতের আঁধারে চোর অর্থকড়ি নিয়ে গেল এমন বিপদে পড়েও যারা ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়ে এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তকে মেনে নেয় তাদের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত বলা হয়েছে, ‘তাদের ওপরই রয়েছে তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে শান্তি ও অনুগ্রহ, আর তারাই কেবল সঠিক পথপ্রাপ্ত। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৭) 

ধৈর্য ধারণের পুরস্কার জান্নাত
প্রিয়জন হারানোর বিপদটিই সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন। প্রিয়জন হতে পারে সন্তান, হতে পারে মা-বাবা কিংবা অন্য কেউ। এ কঠিন বিপদে যারা সওয়াবের আশায় ধৈর্য ধারণ করবে, রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে তাদের পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে, ‘আমি যখন আমার মুমিন বান্দার কোনো আপনজনকে মৃত্যু দেই আর সে সবর করে, তখন আমার কাছে তার একমাত্র প্রতিদান হলো জান্নাত।’ (বুখারি, হাদিস, ৬৪২৪)
বিপদাপদ আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে পরীক্ষা স্বরূপ। হাদিসে এ কথাটি ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে বিপদে আক্রান্ত করেন।’ (বুখারি, হাদিস: ৫৬৪৫) 

বিপদের সঙ্গে বান্দার ভালো-মন্দের সম্পর্ক। ভিন্ন একটি হাদিসে বিষয়টি আরও স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ যখন তার বান্দার কল্যাণ চান, তখন দুনিয়াতে তার শাস্তি ত্বরান্বিত করেন। আর যখন কোনো বান্দার অকল্যাণ চান, তখন তার পাপগুলো রেখে দিয়ে কিয়ামতের দিন তার প্রাপ্য পূর্ণ করেন।’ (তিরজিমি, হাদিস: ২৩৯৬)

আরেকটি হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘সত্যি, বড় পুরস্কার তো বড় বিপদের সঙ্গেই রয়েছে। আর আল্লাহ যখন কোনো সম্প্রদায়কে ভালোবাসেন, তখন অবশ্যই তাদের পরীক্ষায় ফেলেন। তখন যে সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্যই তার সন্তুষ্টি। আর যে অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে, তার প্রতি তারও অসন্তুষ্টি।’ (প্রাগুক্ত) 

দুই কারণে বিপদ আসতে পারে
এ দুই হাদিসের আলোকে বলা যায়, মুমিন নিজের কৃত অপরাধের কারণে বিপদের মুখোমুখি হতে পারে। আবার প্রভুর সঙ্গে তার ভালোবাসার পরীক্ষা স্বরূপও বিপদাক্রান্ত হতে পারে। যে কারণেই হোক, অনাকাঙ্খিত এ বিপদও তার জন্য রহমত হয়ে থাকে।

বিপদ যদি অপরাধের শাস্তিস্বরূপ হয়ে থাকে, তাহলে এ বিপদের কারণে সে গোনাহমুক্ত হয়ে ওঠে। আর বিপদ যদি প্রভুর প্রতি ভালোবাসার পরীক্ষা হয়, তাহলে সবর করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে ভালোবাসার বন্ধন আরও দৃঢ় হবে। বিপদ তাই যেমনই হোক, যে কারণেই হোক আল্লাহর ফয়সালা মনে করে তা মেনে নেয়া, মন্দ ধারণা পোষণ না করা, আর সবরের সঙ্গে বিপদমুক্তির জন্য আল্লাহর শরণাপন্ন হওয়া মুমিন বান্দার কর্তব্য।

বিপদে পড়ে মুমিন অন্যকে অনুযোগের সুরে বলবে না-‘বারবার আমিই কেন বিপদে পড়ি’। বরং চরম বিপদের মুহূর্তেও তার মুখ থেকে উচ্চারিত হবে-‘আলহামদুলিল্লাহি আলা কুল্লি হাল।’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা সর্বাবস্থায় যেভাবে-ই রাখেন, সব প্রশংসা কেবল তার জন্যই। সবর অর্জিত হলে অভাবের কঠিন পরিস্থিতিতেও সে বলবে-আলহামদুলিল্লাহ; আল্লাহর শোকর।

সওয়াবের আশায় বিপদ কামনা না করা
সবরের এ ফজিলতের দিকে চেয়ে কেউ আবার বিপদ ডেকে বসে কি না হাদিসে সে বিষয়ে সতর্কও করা হয়েছে। বিপদ তো এক অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়। সবরের সওয়াবের কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ কখনো কাঙ্ক্ষিত  হতে পারে না। মানুষমাত্রই বিপদ থেকে দূরে থাকতে চায়। বিপদে পড়ে গেলে মুক্তি কামনা করে। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ও ইসলামের শিক্ষা। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘হে লোকসকল! তোমরা শত্রুর মুখে পড়ার কামনা করো না। বরং আল্লাহর কাছে আফিয়াত ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করো। তবে যখন তোমরা শত্রুর মুখোমুখি হয়ে পড়ো, তখন সবর করো।’ (বুখারি, হাদিস: ২৯৬৫)

সর্বশেষ
জনপ্রিয়