ঢাকা, রোববার   ১২ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৮ ১৪৩১

অনাবাদি লবণাক্ত জমিতে সূর্যমুখী আবাদে পাল্টে গেছে দৃশ্যপট

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ২৮ এপ্রিল ২০২৪  

অনাবাদি লবণাক্ত জমিতে সূর্যমুখী আবাদে পাল্টে গেছে দৃশ্যপট

অনাবাদি লবণাক্ত জমিতে সূর্যমুখী আবাদে পাল্টে গেছে দৃশ্যপট

অন্তত ৫০ বছর ধরে মাত্র একটি ফসল আমন আবাদ করেছেন। এর পর মাসের পর মাস পড়ে থাকত অনাবাদি। এই প্রথম আমন ছাড়া অন্য কোনো ফসল সূর্যমুখীর আবাদ করেছেন কৃষক আব্দুল মুমিন। লবণাক্ততার কারণে বাপ-দাদার আমল থেকেই মাত্র একটি ফসল ‘আমন’ নির্ভর ছিল এই জমি। এ বছর এক একর জমিতে সূর্যমুখী আবাদ করেছেন। ফলনও ভালো হয়েছে। ৩০-৩৫ মণ ফলন পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করলেন মুমিন। খরা ও লবণ সহিষ্ণু হাইসান-৩৩ জাতের এই সূর্যমূখির ফলনে গোটা মোয়াজ্জেমপুর গ্রামের মাঠঘাট পরিপূর্ণ। বিবর্ণ, ধূসর বর্ণের মাইলের পর মাইল কৃষি জমিতে এ বছর সবুজ আর হলুদের আস্তরণ। দৃষ্টিনন্দন এই দৃশ্য। ফটোশুটের জন্যও গ্রামটিতে দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে।

গ্রামের বাসিন্দা খায়রুল ইসলাম মিরাজ দেড় একর জমিতে সূর্যমুখী আবাদ করেছেন। ফলনও ভালো হয়েছে বলে জানালেন। একইভাবে নেয়ামুল নাসির, জাহাঙ্গীর সরদার, আলমগীর সরদার, হাবিব মুসল্লি, সুলতান আকনসহ শতকরা ৯০ জন কৃষক এ বছর সূর্যমুখীর আবাদ করেছেন। কেউ কেউ সূর্যমুখী কাটতে শুরু করেছেন। ইসমাইল সিকদার জানালেন, ২৩ কেজি বীজ থেকে নয় কেজি তেল পেয়েছেন। তার ভাষ্য, ‘ঠিকমতো ধানও অয় না, সেখানে সূর্যমুখী ও ভুট্টার আবাদ করেছেন। জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে ফলন পাওয়া গেছে।’ জানালেন, কৃষকরা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক থেকে তারা বীজ, সার ও কীটনাশক পেয়েছেন। পেয়েছেন চাষাবাদের প্রশিক্ষণ।

কলাপাড়া-কুয়াকাটা মহাসড়কের শেখ জামাল সেতু পার হয়ে একটু সামনে গিয়ে পূর্বদিকে পাইকবাড়ির ইটের সড়কে ঢুকলেই সড়কের দুই দিকে মাইলের পর মাইল জমিতে এখন সূর্যমুখীর ক্ষেত। পরিপক্ব হওয়ায় অনেক কৃষক ফসল সংগ্রহ করছেন। ধূসর বিবর্ণ জমিতে এ বছর যেন সূর্যমুখীর বিপ্লব ঘটেছে। ভুট্টা, মুগ ডালের চাষও করেছেন বহু কৃষক। ব্র্যাক সিড অ্যান্ড অ্যগ্রো এন্টাপ্রাইজের সহযোগী পরিচালক আজিজুল হক জানান, হাইব্রিড সূর্যমুখী হাইসান ৩৩ জাতের এই বীজ সরবরাহ এবং কৃষককে চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করায় এ বছর কলাপাড়ায় অন্তত সাড়ে তিন হাজার বিঘা জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ হয়েছে। যাতে প্রায় এক হাজার চারশ’ মেট্রিকটন ফলন হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু মোয়াজ্জেমপুর গ্রাম নয়, কলাপাড়ার ১২টি ইউনিয়নেই ফলন হয়েছে সূর্যমুখীর। বহু কৃষক এখনই ভানাই করে বছরের ব্যবহারের ভোজ্যতেল সংগ্রহের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অনুবিভাগের মহাপরিচালক আবু জুবাইর হোসেন বাবলু বলেন, সরকারের পাশাপাশি টেকসই কৃষি সম্প্রসারণে ব্র্যাকের উদ্যাগসমূহ প্রশংসনীয়। তিনি কৃষি ও কৃষকের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় হাইসান ৩৩ এর মতো ফসল চাষের জন্য কৃষককে আহ্বান জানান।

বিএডিসির সদস্য পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কৃষি উপকরণ হিসেবে কৃষি উৎপাদনে সর্বাধিক গুরুত্ব বহন করে বীজ। বীজ প্রাপ্যতায় বিএডিসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। চলমান কার্যক্রমকে আরও বিস্তৃত করার আশ^াস দেন এ কর্মকর্তা।

ব্র্যাক ক্লাইমেট চেঞ্জ প্রোগ্রামের (জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি) প্রধান আবু সাদাত মুনিরুজ্জামান খান পটুয়াখালীর লবণাক্ত প্রবণ জমিতে সূর্যমুখী চাষ সম্প্রসারণসহ উপকূলীয় অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সহায়তায় উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে ব্র্যাকের সর্বাত্মক চেষ্টার কথা জানালেন। তিনি এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে কৃষককে বিনামূল্যে বীজ, সার, কৃষিউপকরণ প্রদান ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করার কথা বললেন।

অ্যাডভান্টা সিডের কান্ট্রি ম্যানেজার এবিএম জিয়াউর রহমান জানান, হাইসান ৩৩ জাতটির ফলনে উপকূলের কৃষকের জীবন-জীবিকার মানোন্নয়নে উজ্জ্বল সম্ভাবনা ও উপযোগিতা রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ পটুয়াখালীর উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কৃষককে খরা ও লবণ সহিষ্ণু জাতের এসব ফসল আবাদে সরকার সকল ধরনের সহায়তা দিয়ে আসছে। আমরাও সজাগ রয়েছি। কৃষকের পাশে আছি। কৃষি উৎপাদনকে বেগবান করতে তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানালেন তিনি।

ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজেস এর ঊর্ধ্বতন পরিচালক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, উদ্ভাবনী ও টেকসই কৃষির মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন সমন্বিত কার্যক্রমের ইতিবাচকতা বিশ্লেষণ করে জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে কৃষকের সঙ্গে একযোগে কাজ করার দরকার।

সূর্যমুখী আবাদকে ঘিরে শুক্রবার বিকেলে মোয়াজ্জেমপুর গ্রামের খেতের পাশের মাঠে সমাবেশ ঘটে অন্তত ৩৫০ জন কৃষক-কৃষাণির। করা হয় মাঠ দিবস। এরা সবাই আবাদ করেছেন হাইসান ৩৩ জাতের সূর্যমুখী। কৃষক প্রথমবারের মতো অনবাদী থাকা লবণাক্ত জমিতে ফলন পেয়ে মহাখুশি। তবে যথাযথ বাজারজাত করার বিষয়ে কিছু কিছু কৃষক উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে সরকার এবং ব্র্যাকের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানালেন অধিকাংশ কৃষক।

উপজেলা কৃষি অফিসসূত্রে জানা গেছে, এবছর কলাপাড়ায় এক হাজার ২১৯ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ হয়েছে।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়