ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ইসরা ও মেরাজের পরিচয় এবং তাৎপর্য

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:৪৫, ১১ মার্চ ২০২১  

ছবি : সংগৃহীত

ছবি : সংগৃহীত

রজব মাস ইসলামী ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় দখল করে আছে। নবুওয়াতের ১০ম সনে এ মাসে ইসরা ও মেরাজের ঘটনা সংঘটিত হয়। ‘ইসরা’ আরবি শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে রাতে ভ্রমণ করানো, রাতে নিয়ে যাওয়া। শরীয়তের পরিভাষায় রজব মাসের ২৭ তারিখে রাসূল (সা.) এর মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত সফরকে ‘ইসরা’ বলা হয়।

মসজিদে আকসা থেকে আসমান পর্যন্ত যে সফর হয়েছে সেটাকে বলা হয় মেরাজ। ‘ইসরা’ সূরা বনি ইসরাইলের আয়াত দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। মেরাজের ঘটনাও সূরা নাজম ও মুতাওয়াতির হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। মুতাওয়াতির বলা হয় ওই হাদিসকে, যার বর্ণনাকারীর সংখ্যা এত অধিক হয় যে, সবাই মিথ্যা বলা অসম্ভব।
 
সিরাত গ্রন্থগুলোতে মেরাজের প্রেক্ষাপটের উল্লেখ এভাবে এসেছে যে, সপ্তম হিজরি থেকে দশম হিজরি পর্যন্ত ‘শিয়াবে আবু তালেব’ নামক স্থানে রাসূল (সা.) কে অন্তরীণ করে রাখার পর যখন বের হয়ে এলেন প্রথমে চাচা আবু তালেব, তারপর প্রিয় স্ত্রী খাদিজা (রা.) ইন্তেকাল করেন। তাদের মৃত্যুবরণ রাসূল (সা.) এর জন্য ছিল খুবই কষ্টদায়ক। এ কারণে রাসূল (সা.) ওই বছরের নাম দিয়েছিলেন ‘আ’মুল হুজন’ বা শোক-বর্ষ। তাই আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে শান্তনা দেয়ার জন্য নবী করিম (সা.)কে আসমানে ডেকে নিয়ে যান এবং হাদিয়া হিসেবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেন।
 
‘ইসরা ও মেরাজ’ এর প্রেক্ষাপটের সঙ্গে আরো একটি বিষয় যুক্ত করা যায়। সেটি হচ্ছে শুধু শান্তনা দেয়ার জন্য মেরাজের ঘটনা ছিলো না বরং মেরাজ ছিলো দুনিয়ার দায়িত্ব পরিবর্তন করার জন্য আল্লাহর তরফ থেকে ডাক। আমরা জানি, দুনিয়াতে সংশোধনের জন্য যে ধারাটি বেশি কাজ করেছে তা হলো বনি ইসরাইল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে বনি ইসরাইল, ইসলাহ ও সংশোধ, দ্বীনি ও জাগতিক নেতৃত্বের গুণাবলী হারিয়ে ফেলেছিলো, যা ‘ইসরা ও মেরাজ’ সংক্রান্ত সূরা ‘বনি ইসরাইল’ এ বিবৃত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি বনি ইসরাইলকে বলে দিলাম তোমরা দুনিয়ার বুকে দু’বার অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং অতন্ত বড় ধরনের অবাধ্যতায় লিপ্ত হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত নং-৫) এমনকি বনি ইসরাইল মানব জাতির প্রত্যেক সমস্যাকে নিজেদের লাভ ক্ষতির চশমা দিয়ে দেখতো। নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কোথাও শক্তি সামর্থ্য ব্যয় করতে রাজি ছিলো না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন ‘রাব্বুল আলামিন’ সমস্ত সৃষ্টি জগতের প্রতিপালক। 

তিনি শুধু বনি ইসরাইলের রব নন। তাই তিনি বনি ইসরাইলের অযোগ্যতার কারণে তাদেরকে অব্যাহতি দিতে চাইলেন। ওদের জায়গায় দায়িত্ব দিলেন হজরত ইসমাইল (আ.) এর বংশধর মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর উম্মতকে। তিনি মুহাম্মাদ (সা.) এর মাধ্যমে এই উম্মত থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন খাঁটি তাওহিদের প্রচার ও ভ্রাতৃত্ববোধ, সমতা প্রতিষ্ঠার। রাসূল (সা.) বিদায় হজের ভাষণে মেরাজের সেই তাৎপর্যই ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের রব একজন, পিতা একজন, অনারবদের উপর আরবদের কোন শ্রেষ্টত্ব নেই। অনারবদের, আরবদের উপর কোন শ্রেষ্টত্ব নেই। শ্রেষ্টত্ব নেই কালোর উপর সাদার ও সাদার উপর কালোর।’ যেহেতু দায়িত্বের পালাবদলটা ছিলো দ্বীন ও দুনিয়ার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়, মূলত সে জন্যই আল্লাহ তায়ালা হুজুর (সা.) কে ডেকে নিয়েছিলেন। 

উল্লেখিত তাৎপর্য দ্বারা বুঝা যায় মেরাজের ঘটনা ছিল দায়িত্ব দেয়ার জন্য। দায়িত্ব পালন ত্যাগ ও কুরবানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, আনন্দ ও অনুষ্ঠানের সঙ্গে নয়। তাই ইসরা ও মেরাজের ঘটনা উম্মতের উৎসবের বিষয় নয়, সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার বিষয়। এক্ষেত্রে মুসলমানদের বর্তমান ধারণা অনেকটা অমুসলিমদের মতো। ওদের মতো মুসলমানরাও মনে করে তাদের ধর্মীয় ইতিহাসের প্রতিটি ঘটনাকে উৎসবের মাধ্যমে পালন করতে হবে। অথচ অন্যান্য ধর্ম উৎসব সর্বস্ব। যদি ওই উৎসবগুলো না থাকে তাহলে ধর্মের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ইসলাম মনুষ্যত্ব শিখানোর জন্য এসেছে। ইসলামের অনুসারীদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মানবতার খেদমত করার জন্য। যা বছরে দু’একটি অনুষ্ঠান ও এক রাতের উৎসবের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা কখনো সম্ভব নয়। 

ইসরা ও মেরাজের ঘটনা নি:সন্দেহে রাসুল (সা.) এর বৈশিষ্ট্য , অন্য কারো ক্ষেত্রে এটা সম্ভব নয়। কিন্তু নবীর সঙ্গে খা’স হওয়া সত্ত্বেও উদাহরণ সৃষ্টি করা হয়েছে যে, মানুষের পক্ষেই এই উর্ধ্ব জগতে ওঠে আসা সম্ভব হয়েছে, অন্য কোন জাতির দ্বারা এটা সম্ভব হয়নি। এর দ্বারা মানব জাতির ইজ্জত-সম্মান যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনিভাবে মানুষের উন্নতির ব্যাপকতাও বুঝা গিয়েছে। তাই মানুষের উচিত আল্লাহ তরফ থেকে দেয়া ইজ্জত-সম্মানের কদর করা। খোদা প্রদত্ত যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের উন্নতির চিন্তায় মগ্ন থাকা। কবির ভাষায় ‘নিজের সত্তাকে এতো উপরে ওঠাও, যেন খোদা তকদির লেখার আগে জিজ্ঞেস করে নেয় তোমার মর্জি কোনটি?’। 

আল্লাহ তায়ালা এক হাদিসে কুদসিতে মানুষের এই হাকিকত তোলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার কাছে আসতে থাকে, এমনকি এক পর্যায়ে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। তখন আমি তার হাত হয়ে যাই, যে হাত দিয়ে সে ধরে, চোখ হয়ে যাই যা দিয়ে সে দেখে কোনো বস্তু চাইলে আমি তাকে দান করি, আশ্রয় চাইলে আশ্রয় দেই। (সহীহ বুখারী) মেরাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা হচ্ছে নামাজ। নামাজকে বলা হয় নামাজ মুমিনের মেরাজ। কারণ, রাসূল (সা.) যেমন মেরাজের মাধ্যমে সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছেছিলেন, মানুষও চাইলে নামাজের মাধ্যমে সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছতে পারে। কিন্তু মেরাজের রাতে আতশবাজীতে অর্থ ও সময় ব্যয় করতে পারলেও নামাজের জন্য আমরা সময় বের করতে পারি না। 

আল্লাহ তায়ালা রাসূল (সা.) কে মেরাজের মতো মর্যাদার সফর দান করেছিলেন স্বাভাবিক কোনো অবস্থার পরে নয়। দীর্ঘ তিন বছর অবরোধে থেকে যখন বের হয়ে এলেন, অল্প সময় ব্যবধানে দু’জন প্রিয় মানুষকে হারান। এরপর আল্লাহ তায়ালা তাকে নিজের কাছে ডেকে নেন। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় ইজ্জত-সম্মান পেতে হলে আগে ত্যাগ ও কুরবানি পেশ করতে হয়। ত্যাগ ও কুরবানি ছাড়া কখনো সম্মান আসে না।

মেরাজের ঘটনা দ্বারা সাব্যস্ত হয় নবুওয়াতে মুহাম্মাদির দায়িত্ব বিশ্বব্যাপী। শুধু জাজিরাতুল আরবে এটা সীমাবদ্ধ নয়। এ জন্য মসজিদে আকসায় রাসূল (সা.) সমস্ত নবীগণের ইমামতি করেন। তাই বনি ইসরাইলের মতো সব বিষয়কে নিজেদের জাগতিক স্বার্থের চশমা দিয়ে দেখলে চলবে না। তাই উম্মতকে আল্লাহ এই বাণী ‘তোমরা সর্ব শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য’ এর বাস্তব নমুনা হতে হবে।

মেরাজের রাতে নবী করিম (সা.) মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসায় যান। সেখানে সব নবীগণের তিনি ইমামতি করেন। মদীনায় হিজরতের পর মসজিদে আকসা কিছু দিনের জন্য মুসলমানদের কেবলা ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই মসজিদে আকসা মুসলমানদের নেই। ইহুদিদের কবলে থাকায় মুসলমানরা ঠিক মতো নামাজও আদায় করতে পারে না। তাই মেরাজের রাতে আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়ে উম্মাহর উপর যে জিম্মাদারি এসেছে তা পালনে আত্মনিয়োগ করতে হবে। মসজিদে আকসাসহ মুসলিম বিশ্বের সকল সংকট সুরাহার জন্য দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়