ঢাকা, শুক্রবার   ০৩ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২০ ১৪৩১

জাহাজের নাবিকদের আবার সংকেত দেবে বাতিঘর

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৫:৩৬, ৩১ মার্চ ২০২৪  

জাহাজের নাবিকদের আবার সংকেত দেবে বাতিঘর

জাহাজের নাবিকদের আবার সংকেত দেবে বাতিঘর

সমুদ্র বিজয়ের পর আরেক বিজয়ের পথে বাংলাদেশ। ১৭৮ বছর পর আধুনিকায়ন হচ্ছে উপকূলীয় লাইট হাউস বা বাতিঘরগুলো। এ ছাড়া নতুন করে স্থাপন করা হয়েছে আরও চারটি লাইট হাউস। এই টাওয়ারের আলোক সংকেত পেয়েই সমুদ্রে নাবিকরা পথ খুঁজে পায়।

‘এস্টাব্লিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম’ (ইজিআইএমএনএস)’র প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের পুরনো তিনসহ মোট সাতটি বাতিঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর। চলতি বছরের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
নৌ-মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের দিক-নির্দেশনা ও নিরাপত্তার জন্য উপকূলীয় এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে এই লাইট হাউসগুলো। সমুদ্রের ৩০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকা এই লাইট হাউসের আওতায় থাকবে। এর ফলে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় চলাচলরত জাহাজের অবস্থা নিশ্চিত করা যাবে এই লাইট হাউসের মাধ্যমে। সমুদ্রসীমা জয় করার পাশাপাশি সমুদ্রে চলাচলরত জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এই প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে।

২০১৪ সালে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। 
তাই সমুদ্রপথে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের দিক-নির্দেশনা ও যোগাযোগ স্থাপনে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় এই ৭টি লাইট হাউস এবং কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, ভোলার চরফ্যাশনের চর কুকরি মুকরি ও বাগেরহাটের দুবলার চরে নতুন চারটি লাইট হাউস নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্রিটিশ আমলে নির্মাণ করা কক্সবাজার সদর, কুতুবদিয়া ও সেন্টমার্টিন-পুরনো এই তিনটি লাইট হাউস সংস্কার পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।

পাশাপাশি সমুদ্রে জাহাজের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা যোগাযোগ স্থাপনের জন্য কোস্টাল রেডিও স্টেশন (সিআরএস) স্থাপন করা হচ্ছে। ঢাকায় একটি কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে জাহাজের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা যোগাযোগ প্রতিষ্ঠাসহ নৌ নিরাপত্তা ও নজরদারি নিশ্চিত করা যাবে রেডিও স্টেশনের মাধ্যমে।  
এজন্য রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ১১ তলা বিশিষ্ট ঢাকা কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার। এই ভবনটি নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৯২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের জুনে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ক্যাপ্টেন আবু সাইদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমান বলেন, ‘সর্বাধিক আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই লাইট হাউসগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সাতটি লাইট হাউসের বেশিরভাগেরই কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের জুনের মধ্যে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হবে।

এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে নৌ সহায়ক যন্ত্রপাতি স্থাপন ও পরিচালনা করা, আন্তর্জাতিক কনভেনশনের চাহিদা পূরণ, আধুনিক নেভিগেশনাল সহায়তা ও ভেসেল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নৌ নিরাপত্তা প্রসারিত করা, বর্তমান লাইট হাউস আধুনিকীকরণ ও নতুন লাইট হাউস স্থাপন, মেরিটাইম সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ (অনুসন্ধান ও উদ্ধার) কার্যক্রমে সমন্বয় সাধন এবং  সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৯২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।’
বাতিঘরের ইতিহাস ॥ বাতিঘর নামটি শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে একটি ঘরের কথা বলা হচ্ছে যেখানে বাতি জ্বলে। এটি লাইট হাউস নামে পরিচিত। বাতিঘর বা লাইট হাউস হচ্ছে এক ধরনের সুউচ্চ মিনার, টাওয়ার বা দালান, যেখান থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় আলো ফেলে সমুদ্রে নাবিকদের দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়। সমুদ্রের অগভীর অঞ্চল সম্পর্কে নাবিককে সতর্ক করতে বাতিঘর ব্যবহার করা হয়।

এ ছাড়াও সমুদ্র সৈকতের যেসব এলাকায় বেশি প্রবাল রয়েছে এবং যেসব প্রবাল জাহাজের ক্ষতি করতে পারে- এমন সব জায়গা সম্পর্কেও বাতিঘর জাহাজগুলোকে আলোক সংকেত দিয়ে থাকে। বহু যুগ ধরে এই বাতিঘর সমুদ্রে নাবিকদের পথ চলতে সহায়তা করে আসছে। প্রাচীনকালে মানুষ সমুদ্রের অগভীর সৈকত আর প্রবাহ সৈকত চিহ্নিত করতে পাহাড়ের ওপরে আগুনের কু-লি জ্বালিয়ে রাখত। পরবর্তীকালে কাঠ জ্বালিয়ে দূর সমুদ্রের নাবিককে সতর্কবার্তা দেওয়া হতো।
একপর্যায়ে মানুষ সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজের নাবিকদের আলোক সংকেত দিতে বাতিঘর বানায়। প্রাচীনকালে পৃথিবীর সব থেকে বিখ্যাত লাইট হাউস বা বাতিঘর হচ্ছে আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর। আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় তৈরি করা হয়। ধারণা করা হয়, এটি সম্রাট আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর টলেমীয় রাজবংশের সময়ে নির্মাণ করা হয়। প্রথমে বন্দরের পরিচিতি চিহ্ন হিসেবে তৈরি হলেও পরবর্তীতে এটি বাতিঘর হিসেবে কাজ করে।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ আমলে ১৮৪৬ সালে প্রথম তৈরি করা হয়েছিল কক্সবাজারের কুতুবদিয়া দ্বীপের লাইট হাউসটি। এটির উচ্চতা ১২৮ ফিট। এর বাতি প্রতি ১০ সেকেন্ড পরপর জ্বলে ওঠে। যা রাতে অনেক দূর থেকেও দেখা যায়। পরবর্র্তীকালে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নির্মাণ করা হয় আরেকটি লাইট হাউস। এটিরও উচ্চতা ছিল ১২৮ ফিট।

এটিতে প্রতি ৩০ সেকেন্ড পরপর বাতি জ্বলে। পরে কক্সবাজারের সদরে আরও একটি লাইট হাউস নির্মাণ করা হয়। ১৫ সেকেন্ড পর পর এর বাতি জ্বলে। এটির উচ্চতা ছিল ১৭৭ ফিট। এসব লাইট হাউস অনেক পুরনো হয়েছে। তাই এই লাইট হাউসগুলো সংস্কার করা হয়েছে বলে প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা জানান।
প্রকল্পের অগ্রগতি ৯২ শতাংশ ॥ নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ৭টি লাইট হাউস ও কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপন এবং ঢাকায় একটি কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপনের জন্য ২০১৪ সালে ‘এস্টাব্লিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম’ (ইজিআইএমএনএস) প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়।

দুই বছরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তিন দফা ডিপিপি সংশোধন করে ২০২৪ সালে জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৮১৮ কোটি ৭৫ লাখ ১১ হাজার টাকা। এর মধ্যে কোরিয়া ঋণ সহায়তা দিয়েছে ২৮৯ কোটি ১ লাখ ৮১ হাজার টাকা। বাকি ৫২৯ কোটি ৭৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা সরকারি নিজস্ব ফান্ড থেকে ব্যয় করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৯২ দশমিক ১০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
সাতটি বাতিঘরের প্রায় সবগুলোর কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে পুরনো কক্সবাজার বাতিঘরটি নতুন করে নির্মাণের জন্য ২০১৭ সালের ৯ মার্চ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ১১ আগস্ট। ইতোমধ্যে ৩ তলা কোস্টাল রেডিও স্টেশন, ২ তলা স্টাফ হাউস ও কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপন কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে কক্সবাজার বাতিঘরে আইসিটি স্থাপনের যাবতীয় কাজ চলমান আছে। ৯৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। দুই-এক মাসের মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ হবে।

কুতুবদিয়ায় দ্বিতীয় বাতিঘর নির্মাণ করা হয়েছে। পুরনো বাতিঘরের স্থানে নতুন করে টাওয়ার ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। কুতুবদিয়া বাতিঘরের নির্মাণ কাজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০১৮ সালে ১৬ মার্চ। নির্মাণ কাজ শুরু হয় ওই বছরের ১৪ আগস্ট।  ইতোমধ্যে কুতুবদিয়া বাতিঘরের স্টিল লাইট টাওয়ার নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া ৩ তলা কোস্টাল রেডিও স্টেশন, ২ তলা স্টাফ হাউস ও কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপন কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সার্বিক অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ।
সেন্টমার্টিনে তৃতীয় বাতিঘর বা লাইট হাউস নির্মাণ করা হচ্ছে। পুরনো এই লাইট হাউসটি নতুন করে নির্মাণের জন্য ২০১৭ সালের ১০ মার্চ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৯ নভেম্বর। ইতোমধ্যে সেন্টমার্টিন লাইট হাউসের স্টিল লাইট টাওয়ারের ভিত ঢালাই সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া ৪ তলা কোস্টাল রেডিও স্টেশন ও ২ তলা স্টাফ হাউসের কাজও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সেন্টমার্টিন বাতিঘরের কাজের ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
চতুর্থ বাতিঘরটি নির্মাণ করা হচ্ছে নোয়াখালী জেলার হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে। এই বাতিঘরটি নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের ২ মার্চ এটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ইতোমধ্যে স্টিল লাইট টাওয়ার ইরেকশনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া ৩ তলা কোস্টাল রেডিও স্টেশন ও ২ তলা স্টাফ হাউস নির্মাণ শেষ হয়েছে। সার্বিকভাবে ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

পঞ্চম বাতিঘর নির্মাণ করা হচ্ছে পটুয়াখালীর কুয়াকাটায়। নতুনভাবে নির্মাণ করা এই বাতিঘরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট। নির্মাণ শুরু হয় ২০১৮ সালের ১৬ নভেম্বর। ইতোমধ্যে স্টিল লাইট টাওয়ার, ৪ তলা কোস্টাল রেডিও স্টেশন ও ২ তলা স্টাফ কোয়ার্টার নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। সার্বিক অগ্রগতি ৯৬ শতাংশ। ষষ্ঠ বাতিঘর নির্মাণ করা হচ্ছে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চর কুকরি মুকরিতে।

নতুনভাবে নির্মাণ করা এই বাতিঘরের ৭৫ মিটার দীর্ঘ স্টিল লাইট টাওয়ার নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া ৩ তলা কোস্টাল রেডিও স্টেশন (সিআরএস) ভবন ও ২ তলা স্টাফ হাউস নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। সার্বিক অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ। সপ্তম বাতিঘর নির্মাণ করা হচ্ছে বাগেরহাটের দুবলার চরে। নতুনভাবে নির্মাণ করা এই বাতিঘর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০১৮ সালের ১৮ মার্চ। নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর। ইতোমধ্যে বাতিঘরের স্টিল লাইট টাওয়ার নির্মাণ, ৩ তলা কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপন ও ২ তলা স্টাফ হাউসের নির্মাণ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সার্বিকভাবে ৯৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা জানান।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়